
সাজেকের পথে আজকাল এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না - লেখক
সাজেক যেতে চাইনি আমি। জনপ্রিয় কোনো কিছু আমাকে তেমন টানে না। তবে সহজে অনুরোধ ঠেলতেও পারি না। সেবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পীড়াপীড়িতে সাজেক যেতে হলো। কিন্তু অনিচ্ছুক যাত্রাকেও তো প্রিয় করে তুলতে হবে। সে জন্য ডেকে নিলাম অনুপমকে। অনুপম দে খাগড়াছড়ির ছেলে। ওর পরিবার এই অঞ্চলের আদি বাঙালিদের অন্যতম। আদিবাসীদের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা নিত্যদিনের আন্তরিকতায় ভরা। অনুপমের আছে যে কোনো মানুষকে গল্পে, জ্ঞানে, গানে আনন্দিত করে রাখার অসীম ক্ষমতা। সে বলছিল, খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাবার সর্পিল পথটা যখন প্রথম হলো তখনও এখানকার মানুষদের মধ্যে 'প্রাইভেসি জ্ঞান' জন্মায়নি। ও একজন অর্ধবসনার ছবি তুলে নিজেই অপরাধবোধে ভুগছিল। যদিও ছবিটা ও কখনও ব্যবহার করেনি। কিন্তু যার ছবি তোলা হলো, তার এ নিয়ে কোনো বিকার হয়নি। তিনি জানতেন না এই ছবি কারও জন্য কৌতূহলের বা আগ্রহের বিষয় হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা মনে আসছে, একবার ডালিয়া চাকমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, 'আদিবাসীদের সন্তানসংখ্যা কম হয় কেন?' ও বলল, 'কোনো বিষয়েই অতি আগ্রহ না থাকার কারণে হতে পারে।' মানে হলো যে, নর-নারীর সম্পর্কও এখানে জীবন-মৃত্যু-ক্ষুধা-অনাহারের মতো সহজ ব্যাপার। একে বিশেষায়িত করার প্রবণতা নেই আদিবাসীদের মধ্যে।
২০১৭ সালে সাজেকের পাহাড়ি পথ খুবই মসৃণ ছিল আমাদের গাড়ি চলবার জন্য। যদিও গ্রামগুলোকে সংযুক্ত করে খাবার বা পানি আনবার মতো পথ ছিল না। ভ্রমণকারীদের জন্য অথবা শাসনকারীদের জন্য এই মসৃণতা সত্যি লক্ষণীয় এবং প্রিয় হবার কথা। এ যেন আধুনিক নগরের মসৃণতা অথবা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের সাজসজ্জার মতো। পথ মসৃণ হলেও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। দুই ধারে সোনালি রোদে দুপুরের বন কেবল ঝলকে উঠছিল। এর দুই ধারের সৌন্দর্যকে তখন কেবল আগুনের সঙ্গেই তুলনীয় মনে হয়েছিল। সুজন চাকমা নামে একজনের কথা পড়েছিলাম এক বন্ধুর লেখায়। পাহাড়ে উন্নয়ন নিয়ে আলাপে এই সুজন চাকমা পথকে সাপের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলার জন্য নয়, বরং রাস্তা বয়ে আনতে পারে বিষাক্ত কোনো বিপদ। রাস্তা হলে কী হয়? ঠিকাদার আসে। বহিরাগতরা আসে শ্রমিক হয়ে। বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্প। স্থায়ীভাবে থেকেও যায় তাদের কেউ কেউ। উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয় আদি বাসিন্দারা। এই যেমন সাজেকের কথাই ধরা যাক, খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক পৌঁছানোর সড়ক যখন হলো, তখন সেখানকার আদি বাসিন্দা ত্রিপুরা, পাঙ্খোয়া এবং লুসাইরা নিজের ভূমিতে টিকে থাকতে পারল না।
সাজেকের পাঙ্খোয়া আর লুসাইদের বেশিরভাগই মিজোরাম চলে গেছে বলে জানালেন এক বন্ধু। মিজোদের সঙ্গে লুসাই ও পাঙ্খোয়াদের সাংস্কৃতিক মিল আছে বেশ। ব্যাপারটা এতো সরল না আদতেই। ধরেন, বাড়ির পাশের একটা ছড়ায় অজানা কেউ একদিন বিষ ঢেলে দিল। ছড়া হলো ঝরনা থেকে নেমে আসা চিকন জলের ধারা, পাহাড়ের মানুষের কাছে সুপেয় জলের উৎস। জলের অভাবে মানুষ অভিবাসিত হলো দূরে কোথাও। বাংলা ভাষা এবং প্রশাসনিক রীতি না জানা আদিবাসীরা কোথাও অভিযোগ করতে গেল না। বরং হাঁটতে হাঁটতে দূরে কোথাও চলে গেল, যেখানে নতুন বসতি গড়া যায়। সেটা বাংলাদেশে, নাকি বাংলাদেশ সীমার বাইরে তা তারা জানে না। হয়তো আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো জুম ক্ষেতে। তারা চলে গেল অন্য কোনো পাড়ায়। পরে আবার ফিরল, কিন্তু বসতভিটা ফিরে না পেয়ে আবারও চলে যেতে হলো তাদের। মগের মুল্লুকের গল্প বলছি বলে মনে হলেও এভাবেই শত শত আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই স্থানান্তর, অভ্যন্তরীণ নাকি বহিঃস্থ- সেসব হিসাব অভিবাসীবিষয়ক সংস্থাগুলো জানে হয়তো। যারা ঘর ছাড়ে তারা হিসাব রাখে না। আদিবাসীদের ছেড়ে যাওয়া ওই সব ভূমিতে যাদের রিসোর্ট করার কথা, তারা রিসোর্ট বানায়, যাদের প্রকৃতি দেখার শখ, তারা ভ্রমণে যায়।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় নব্বই শতাংশ আদিবাসী থাকলেও এখন তারা সাতচল্লিশ শতাংশ। মানুষের জন্য যদি পথ হয়, মানুষেরা সেই পথ ছেড়ে চলে গেল কেন? সাজেকে খাবার আর পানির অভাব আগেও ছিল। উন্নয়নের জন্য প্রতিটা বিচ্ছিন্ন এলাকার সমস্যাকে আলাদাভাবে আমলে নিতে হয়। সাজেকে সুপেয় পানির উৎসের সঙ্গে যুক্ত হবার পথ দরকার ছিল। দরকার ছিল খাবার সরবরাহের জন্য পথ। কিন্তু পথ হলো পর্যটকদের জন্য। আর সাজেকের আদিবাসী মানুষেরা বেঁচে থাকার পথ করতে এলাকা ছেড়ে চলে গেল।
দীর্ঘ পাহাড়ি পথ গাড়িতে করে যাওয়ার পরেও গা ব্যথা নিয়ে সাজেক নামলাম। প্রকৃতি সেখানে এখনও অনেক সুন্দর। যদিও ছবি তুলতে মন চায়নি সেবারে। মনের মধ্যে সাজেকের স্মৃতি খুঁজে পাওয়া এত কঠিন, যেন আসলে কখনও সাজেক যাইনি। সাজেককে এত ভুলে গেলাম কেন? ভুলে গেলাম কারণ, সে পাথরের মানবী মূর্তির মতো নিষ্প্রাণ সুন্দর এক পাহাড়। প্রাণহীন পাহাড়কে পাশে রেখে পথ চলা যায় না। তাকে স্মরণে আনাও কঠিন। দিনের নির্দিষ্ট কয়েকটি সময়ে গাড়ির বহর চলে এই পথে। যখন-তখন কেউ এদিকে আসতে পারে না। এতো মসৃণ পথে এতো ক্লান্তি এলো, রাতটাও কেমন যেন থেমে ছিল। যেখানে সব গাড়ি গিয়ে থামল সেখানে শুধু কয়েকটা হোটেল। কোনোটা থাকার, কোনোটা খাবার। সকালটা ছেলেমেয়েরা অনুপমের সঙ্গে নানান জায়গায় ঘুরে এলো। আমি কোনো উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। কেবল বারান্দায় বসে বসে গান শুনে আবার দুপুরের ফেরার গাড়ির অপেক্ষা করলাম।
সব অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গেল কেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বিদেশী শিক্ষাবিধি রেলকামরার দীপের মতো' বলে যে উদাহরণ দিয়েছিলেন, এই পর্যটন কেন্দ্র দেখে সেই কথাগুলো মনে এলো- 'কামরাটা উজ্জ্বল, কিন্তু যে যোজন যোজন পথ গাড়ি চলেছে ছুটে সেটা অন্ধকারে লুপ্ত। কারখানার গাড়িটাই যেন সত্য, আর প্রাণবেদনায় পূর্ণ সমস্ত দেশটাই যেন অবাস্তব।' সাজেককেও আমার কারখানায় তৈরি পর্যটন বলে মনে হয়েছিল। সন্ধ্যায় পাশের হোটেলে হিন্দি গান বাজছিল। একপাশে বারবিকিউ পার্টি চলছিল। আরেক কোণে কিছু ছেলে গান গাইছিল। আর কেউ নেই। শিশু, নারী, পুরুষ- কেউ নেই, যারা ছিল এই এলাকার আদি বাসিন্দা। সাগরসঙ্গম বন্ধ হলে নদী তো কেবল মরা নদী। সমাজ ছাড়া একটা-দুটো পরিবারকে বোধ হয় দরকারি কাজকর্মের জন্য রাখা হয়েছে। অথবা শোকেসে সাজানো আদিবাসী মানুষ। শিশুদের গাড়ি থেকে চকলেট ছুড়ে দেয় পর্যটকরা। আচ্ছা উপহার কি ছুড়ে দেওয়া যায়? সমাজহীন এই শিশুরা দর্শনার্থীদের কাছে হাত পেতে দাঁড়াতে শিখে গেছে। লুসাই নাচ, রঙিন কাপড় বোনা শিখেছে কিনা কে জানে? পাহাড়ে কি সাবলীল বিচরণ সম্ভব? আমাদের গাড়ি তো পথে এক মিনিটও দাঁড়াতে পারেনি।
মন্তব্য করুন