ঢাকা থেকে ফেনী হয়ে দাগনভূঞার গ্রামীণ আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা ছুটে চলছি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের পথে। শুক্রবার। রাত তখন সাড়ে ১২টা ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বসুরহাট পৌর এলাকায়। উপজেলার বড় বাণিজ্যিক এলাকা এটি। প্রবাসী অধ্যুষিত এ এলাকায় বাজার-ঘাট সাধারণত গভীর রাত পর্যন্ত সরগরম থাকে। কিন্তু এখন ১২টার মধ্যেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। সকাল যখন হলো, কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে আর চারপাশ দেখেই বোঝা গেল কারণ কী। আতঙ্ক ভর করেছে এখানে।

গতকাল শনিবার ভোরের আলো ফুটতেই পাল্টাপাল্টি স্লোগান ও সমাবেশে গমগমে হয়ে ওঠে পুরো জনপদ। আবদুল কাদের মির্জার ডাকে হরতালের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। মোড়ে মোড়ে দেখা গেল পুলিশ-র‌্যাবের ব্যাপক উপস্থিতি।

এর আগে সবশেষ ২০১৩ সালে ছাত্রশিবির ও পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল কোম্পানীগঞ্জ। ওই সময় প্রাণ হারিয়েছিলেন আটজন। প্রায় আট বছর পর আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সংসদীয় এই এলাকা। ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌর মেয়র কাদের মির্জার 'সত্য বচনে' শুরু হয় অস্বস্তি। ধীরে ধীরে তা রূপ নিয়েছে সহিংসতায়। পাশের জেলা ফেনীতেও ছড়িয়ে পড়ছে উত্তাপ। চলছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি।

গত কিছুদিন কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার একক সভা-সমাবেশ হলেও শুক্রবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল মাঠে নামেন। এরপর দু'জনের অনুসারীদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ৬০ জন আহত হন। এর মধ্যে অন্তত সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয় এক সাংবাদিকও রয়েছেন। তিনি ঢাকার হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দু'পক্ষের লোকদের হাতেই দেখা গেছে আগ্নেয়াস্ত্র। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনে কোম্পানীগঞ্জে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহ। এলাকার বাইরে থেকে বন্দুকধারী কিছু সন্ত্রাসীও প্রবেশ করেছে।

সূত্রটি আরও জানায়, কোম্পানীগঞ্জে কারও কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্র নেই। মাঠ দখল করতে পেশাদার সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ। সন্ত্রাসীদের হাতে দেশীয় এলজি, শটগান, চায়না পিস্তল মিলিয়ে দেশি-বিদেশি ১৫টি অবৈধ অস্ত্র আছে। গত কয়েকদিনে আরও অন্তত ১২টি অস্ত্র এসেছে। এগুলো নোয়াখালী সদর ও ফেনী থেকে আনা। অনেক সন্ত্রাসীও এসেছে এলাকার বাইরে থেকে।

কোম্পানীগঞ্জে এখন প্রতিদিন ককটেলের বিস্ম্ফোরণ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটছে। গতকাল দুই অস্ত্রধারীকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।

গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ১১ অস্ত্রধারীকে দেখতে পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে সকাল ১১টার দিকে পেশকারহাট এলাকায় দুই, তিনজন করে মোট আট অস্ত্রধারীকে দেখা যায়। তারা মোটরসাইকেলে মহড়া দিচ্ছিল। সবার মাথায় ছিল হেলমেট আর শরীর চাদরে মোড়ানো। চাদরের ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে অস্ত্র বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়। অস্ত্রধারীদের মহড়ার সময় ওই এলাকায় সমাবেশের মতো করে চলছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের সংবাদ সম্মেলন।

সংবাদ সম্মেলনের পরও বিকেল ৫টা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বসুরহাটের রূপালী চত্বর এলাকায় দুপুর ১২টার দিকে একটি মোটরসাইকেল মহড়ায় তিনজনের কাছে অস্ত্র দেখা যায়। একটি সেতুর আশপাশে দীর্ঘসময় তারা আড্ডা দিয়েছে।

এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অস্ত্রধারীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাদল সমকালকে বলেন, 'এদের আমি চিনি না।'

তার ভাষ্য, আমি সারাজীবন অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জে একক আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছেন। তিনি চান না আর কেউ রাজনীতি করুক। তিনি এখন মাঠ দখল করতে অস্ত্রবাজদের ব্যবহার করছেন। আমি তার অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছি।

গুলিবিদ্ধ সাতজনের মধ্যে ছয়জন জেলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম সমকালকে বলেন, তাদের শরীরে ছররা গুলি লেগেছে। এগুলো মূলত এলজি ও শটগানের গুলি।

আওয়ামী লীগের একপক্ষের অভিযোগ, কাদের মির্জা বিপক্ষের শক্তিকে প্রতিহত করতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছেন। বিপরীতে কাদের মির্জার অভিযোগ, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী, মিজানুর রহমান বাদল, দাগনভূঞার দিদার ও স্বপন মিয়াজী প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। সেই অস্ত্র ব্যবহার করে তারা আমার কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের কোন্দল গোলাগুলিতে রূপ নেওয়া প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম চৌধুরী সমকালকে বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কোম্পানীগঞ্জের এই অস্থির অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কাদের মির্জা যেসব কথা বলছেন, তা মিথ্যা। তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন। আমরা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে কোম্পানীগঞ্জের সাম্প্রতিক সহিংস অবস্থার বিষয়ে জানিয়েছি। আশা করি, তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

বসুরহাটের এক ব্যবসায়ী সমকালকে বলেন, উপজেলায় এই মুহূর্তে অন্য কোনো দলের কর্মসূচি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, অথচ সেই দলের নেতারা অস্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন সমকালকে বলেন, শুক্রবারের সংঘর্ষের সময় পুলিশ যদি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিত, তাহলে সেখানে অনেক লাশ পড়ত। আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।

এসপির ভাষ্য, কোম্পানীগঞ্জে কোনো অস্ত্রবাজের রক্ষা নেই। যে দলেরই হোক, আমরা তাদের গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছি। আমাদের কাছে অস্ত্রের যে তথ্য আছে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।