সাধারণত একটি রাবার গাছ থেকে ৩২ বছর পর্যন্ত কষ সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু ১৫-১৭ বছর বয়সী গাছকে উৎপাদনে 'অক্ষম' দেখিয়ে ব্যাপক হারে নিধন করা হচ্ছে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় গড়ে তোলা রাবার প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অকালে এসব রাবার গাছ নিধনের পেছনের উদ্দেশ্য প্রকল্পের জমি লিজ দিয়ে কর্মকর্তাদের 'পকেট ভারী' করা। তাই গাছ সাবাড় করে একরের পর একর জমি লিজ দিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা। স্থানীয় প্রভাবশালীরা লিজ নেওয়া সেই জমি ফের দ্বিগুণ টাকার বিনিময়ে লিজ দিচ্ছেন কৃষকদের। কৃষকরা তাতে চাষ করছেন হলুদ, আনারস।
তবে রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক মফিজুল হক খানের দাবি, তারা জমি লিজ দেননি; স্থানীয় প্রভাবশালীরা জোরপূর্বক জমি দখল করেছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুরে প্রায় এক হাজার ৭৬ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) রাবার উন্নয়ন প্রকল্প। যেটি সন্তোষপুর রাবার বাগান নামে পরিচিত। গত কয়েক মাসে এ প্রকল্পের ১৫০ একর জমির গাছ কেটে উজাড় করা হয়েছে। কষ উৎপাদনে অক্ষম দেখিয়ে সংশ্নিষ্টরা এ কাজ করছেন।
নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এক্ষেত্রে 'দক্ষ কৌশল' নিয়েছেন প্রকল্পের অসাধু কর্মকর্তারা। অদক্ষ টেপার দিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে টেপিং (নিয়ন্ত্রিত কাটার মাধ্যমে রাবার গাছ থেকে কষ সংগ্রহের পদ্ধতি) করিয়ে গাছগুলোকে উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বয়সেই শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকায় গড়ে তোলা 'সাদা সোনা' খ্যাত এ রাবার প্রকল্পটি।
সন্তোষপুর রাবার প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বাগান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে বদলি হয়ে আসা 'ম্যানেজার বাবুদের' পকেট ভারী করতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। প্রশিক্ষিত টেপারদের ছাঁটাই করে দুস্কৃতকারীদের পছন্দের অনভিজ্ঞ টেপার দিয়ে গাছ টেপিং করা হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত টেপিং করায় গাছগুলো অকালেই কষ দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। গাছের বয়স সাত বছর হওয়ার আগে টেপিং করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, তা থোড়াই কেয়ার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, অন্তত দুইশ একর রাবার প্রকল্প এলাকায় গাছ কেটে ফেলায় পরিণত হয়েছে বিরান ভূমিতে। প্রকল্প অফিসপাড়ায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় কয়েক হাজার গাছ পড়ে আছে। গাছ উজাড় করে খালি করা জমি প্লট আকারে লিজ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। তাদের কাছ থেকে সেই জমি আবার লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন কৃষকরা। প্রতি একর জমির ক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা করে। এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই টাকার একটি অংশ যাচ্ছে প্রকল্প কর্মকর্তাদের পকেটে।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় ইউপি সদস্য মাসুদ ও নুরুল ইসলাম গং প্রকল্পের দখল করে কৃষকের কাছে লিজ দিয়েছেন। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
কৃষক হুরমুত আলী জানান, তিনি এক একর জমি স্থানীয় ইছু মেম্বারের কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় লিজ নিয়েছেন। তার প্লটে ১৩ হাজার আনারসের চারা লাগানো হয়েছে। এখন কেউ আনারসের চারাসহ তিন লাখ টাকা দিলে তাকে জমি দিয়ে দেবেন।
বাগানের ব্যবস্থাপক মফিজুল হক খান সমকালকে বলেন, 'পুরোনো গাছ কেটে ফেলার পর প্রায় ১২০ একর জমিতে নতুন চারা লাগানো হয়। চারা লাগানোর পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ মেম্বার, নাওগাঁও ইউপি সদস্য ইসলাম গং জোর করে রাবার বাগানের জমিতে আনারস লাগায়। অসহায় হয়ে রাবার গাছগুলোকে রক্ষার স্বার্থে তাদের কিছু বলিনি।'
তিনি বলেন, 'আমি নিজেও বিভিন্ন সময় হুমকির মুখে পড়ি, কখনোই কিছু বলতে পারিনি। তারা এই জমি কীভাবে লিজ দিয়েছে, কত টাকা করে কৃষকদের কাছ থেকে নিয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই জানি না। কথিত এই লিজের কোনো টাকা আমাকে কিংবা অফিসকে দেওয়া হয়নি।'
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, 'আমি রাবার প্রকল্পের জমি দখল করে লিজ দিয়েছি, এসব মিথ্যা কথা।'
মফিজুল হক খান আরও বলেন, 'অতীতের সব অনিয়মের চাপ এসে পড়েছে আমার কাঁধে, বাগানের গাছ অনুযায়ী কষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছি না। তাই আগের যে গাছগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে, বিএফআইডিসির নির্দেশে সেগুলো কেটে নতুন চারা লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।'
বাগানের সাবেক এক ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মূলত ২০১০-২০১৩ সাল পর্যন্ত যারা বাগানের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তাদের অনিয়মতান্ত্রিক তদারকির কারণে বহু গাছ মারা গেছে। লক্ষাধিক গাছ কোনোরকমে বেঁচে বা অর্ধ মৃত অবস্থায় থাকলেও উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এর পেছনে কারণ অনিয়ন্ত্রিত টেপিং।


বিষয় : রাবার গাছ উজাড় করে আনারসের চাষ

মন্তব্য করুন