বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকের লাশ পড়ার ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। এতদিন পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষের কথা আলোচনায় থাকলেও এখন সামনে এসেছে 'বহিরাগতরা'। ঘটনার পর এস আলম গ্রুপের দায়ের করা মামলায় কোনো শ্রমিককে আসামি করা হয়নি। যে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে তারা কেউ শ্রমিক নন, স্থানীয় বাসিন্দা। বিদ্যুৎকেন্দ্রে নাশকতা চালাতে তারাই নেপথ্যে শ্রমিকদের উস্কানি দিয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারেও দাবি করা হয়েছে, শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে বহিরাগতরা গুলি করেছে পুলিশকে। তারাই গাড়িতে আগুন দিয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশ সুপার নেছার উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ঘটনার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্য নিচ্ছি। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। সংগ্রহ করেছি মামলার এজাহারও। সব কিছু বিচার-বিশ্নেষণ করেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে তদন্ত কমিটি।'
অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার বলেন, 'শ্রমিকরা হঠাৎ করে কেন এতটা বিক্ষুব্ধ হলো, এটির নেপথ্যে অন্য কোনো শক্তি ছিল কিনা- সব বিষয় মাথায় নিয়েই তদন্ত করছি আমরা। এ পর্যন্ত সাতজনের সাক্ষ্য নিয়েছি। ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করেছি। আশা করছি নির্ধারিত সময়েই আমরা প্রতিবেদন দিতে পারব।'
মামলার আসামি যারা :বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনার আমিন উল্লাহর ছেলে আব্দুর রশিদ, এমদাদ মিয়ার ছেলে নুরুল আলম, তৈয়ব ও নুনু মিয়া, গণ্ডামারা গ্রামের বদি, মৃত আহমদ কবিরের ছেলে আবুল কালাম, পশ্চিম বড়ঘোনার দুদু মিয়ার ছেলে নুরুল ইসলাম, সকাল বাজার গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে আবু সিকদার, পশ্চিম বড়ঘোনার মৃত মফজল হোসেন সিকদারের ছেলে নুরুল আবছার, মৃত মোক্তার আহমদের ছেলে শাহাবুদ্দিন, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের টুনু মিয়ার ছেলে ভেট্টা, লাল মিয়ার ছেলে আবুল বাশার, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গুরা মিয়ার ছেলে হাসু রফিক, শাহা আলমের ছেলে ফজল করিম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আফজল আহমদের ছেলে মহিউদ্দিন, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদ আহমদের ছেলে ছৈয়দ নুর, আবদুর রাজ্জাকের ছেলে রশিদ, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পেচু মিয়ার ছেলে আমির হোসেন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নওশা মিয়ার ছেলে জমির হোসেন, ছৈয়দ আহমদের ছেলে মঞ্জুর আহমেদ, মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে আলী হায়দার আসিফ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁন মিয়ার ছেলে কালু মিয়া। তাদের কেউই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক নয় বলে দাবি করেছেন মামলার বাদী ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, 'স্থানীয়দের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির একটি অংশ শুরু থেকেই এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। আরেকটি অংশ এ প্রকল্প থেকে নানাভাবে সুবিধা নিতে চেয়েছে। তারাই ইন্ধনদাতা ছিল এ ঘটনার। দাবি পূরণ করার পরও সহিংস হওয়ার কারণ এটি।'
পুলিশকে গুলি করল কারা :ঘটনায় আহত গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. রাশেদুজ্জামান বেগের দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, ঘটনার সময় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল বহিরাগতরা। শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে তারা পুলিশের ওপর গুলি বর্ষণ করে। কিন্তু ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কোনো পুলিশ সদস্যকে পাওয়া যায়নি। রাশেদুজ্জামান বেগসহ যে পাঁচজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের কেউ গুলিবিদ্ধ ছিলেন বলে দাবি করা হয়নি। ইট-পাটকেলের আঘাতেই আহত হয়েছেন এ পাঁচ পুলিশ সদস্য। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘটিত ঘটনায় যে পাঁচজন শ্রমিক মারা গেছেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। হাসপাতালে এখন যারা কাতরাচ্ছেন তাদের মধ্যেও ১৩ জন গুলিবিদ্ধ। শ্রমিকরা বলছেন, বিনা উস্কানিতে শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এখন ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে এজাহারে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।
৯ দফা দাবির আটটিই মানা হয়েছিল- দাবি কর্তৃপক্ষের :পুলিশ ও এস আলম গ্রুপের দায়ের করা মামলার দুটিতেই বলা হয়েছে- শ্রমিকদের ৯ দফা দাবির আটটিই মেনে নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। শুধু শুক্রবারে পাঁচ ঘণ্টা ডিউটি করে ১০ ঘণ্টার বেতন নেওয়ার দাবিটি পূরণ করেনি তারা। এরপরও কেন শ্রমিকরা সহিংস হলো, কারা তাদের উস্কানি দিল সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে উভয় এজাহারে। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিক আজিজুল হক বলেছেন, তাদের কোনো দাবিই মেনে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ করেছেন তারা। আর বিক্ষোভ দমাতেই পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
হত্যার বিচার দাবি স্বজনদের :বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংঘর্ষে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন স্বজনরা। তারা কেউ মামলা করতে রাজি না হলেও প্রকৃত দোষীদের শনাক্তের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, জীবন বাঁচাতে তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ নিয়েছিলেন, জীবন দিতে নয়। প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে যেন বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের আর কোনো ঘটনা না ঘটে সেটিও যেন নিশ্চিত করা হয়।
সংঘর্ষে নিহত বাঁশখালীর গণ্ডামারার বাসিন্দা মাহমুদ রেজার মামা মোহাম্মদ ফরহাদ উল্লাহ সমকালকে বলেন, 'কার বিরুদ্ধে মামলা করব। এত বড় ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মামলা করে কি আমরা পেরে উঠব। ছেলে হারিয়ে আমার বোন এখন নির্বাক। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যারা আমার ভাগ্নেকে খুন করেছে তাদের যেন শাস্তি হয়। ভবিষ্যতে কাজ করতে এসে যেন আর কারও মায়ের বুক খালি না হয়।'
শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন :বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত পাঁচজনের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এটিকে শ্রমিকদের দরিদ্রতার সঙ্গে চরম তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা। গতকাল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে তারা এ কথা বলেন।
মানববন্ধনে শ্রমিক নেতারা নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ও আহত শ্রমিকদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের দাবি জানান। চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক তপন দত্তের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মুহাম্মদ শফর আলী, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এ এম নাজিম উদ্দিন, টিউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মসিউদ্দৌলা, বিএফটিইউসির কে এম শহিদুল্লাহ, শ্রমিক জোটের আব্দুল মোমেন, পরিবহন শ্রমিক নেতা উজ্জ্বল বিশ্বাস, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের হেলাল উদ্দিন কবির প্রমুখ।