ঢাকায় যাদের বাস, ৯৯ ভাগই বাংলাদেশের নানা প্রান্তর, জেলা-মহকুমা, গঞ্জ, গ্রাম থেকে আগত। কারোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'দেশের বাড়ি কোথায়?' কলকাতার বয়স্ক লোকের মুখে শুনেছি, দেশ ভাগের পরে প্রায় একই প্রশ্ন পূর্ববাংলার কোন জেলায় বাড়ি? অর্থাৎ, কলকাতাসহ কলকাতার আশপাশের শহরে, পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

শঙ্খ ঘোষকে এসব কিছুই বলতে হয় না, তার বহু লেখায়, গদ্যে, স্মৃতিচারণমূলক লেখায় প্রকাশিত। জীবনী লেখেননি, না-লিখলেও পাঠক তার জীবন, জীবনের বিস্তর ঘটনাবলি জেনেছেন বইয়ে মুদ্রিত লেখনী থেকে। জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের, আজকের বাংলাদেশের। নাগরিকত্ব ভারতীয়। দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু কলকাতায়। আমৃত্যু বসবাসও ওখানে। কিন্তু মনেপ্রাণে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ নিয়ে তার রচনার সংখ্যাও কম নয়। সেইসব লেখা নিয়ে ঢাকা থেকে বই বেরিয়েছে। আরও দুটি বইও। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কবিতাও।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন আট লাইনের। শিরোনাম :'ঢাকা ১৯৭৫'।

সমস্ত ধুলোর মধ্যে মিশে থাক স্তব

তোমার পায়ের মুদ্রা থেমে থেমে যাবে

প্রতিটি সকাল থেকে ভ্রমণের স্মৃতি

চোখের প্রথম মুক্তি নদীতে তাকাবে

কৃষ্ণচূড়ার এ শহর করে দিক রাধা

তখনই সবার বুকে দামামা বাজাবে

ছিন্ন মুহূর্তের সেই ভস্ম হওয়া জ্বালা

সেদিন আমার ছিলে, আজ কার পালা?

স্মৃতি তাকে নানাভাবে উদ্ভাসিত করেছে। উদ্ভাষণে পেয়ে যাই, 'আমার পাকশী' নামের কবিতায়। ১৮ লাইনের শিশুতোষ কবিতা। ছড়ার আমেজও ষোলোআনা। ভুলতে পারেন পাকশী। মধুর স্মৃতি।

যতই হাসো, যাই বলো লিখে তো রাখছি

দুনিয়ার যে সেরা শহর-সে হল পাকশী।

অবশ্য ঠিক শহরও নয়, শহর-মেশা গ্রাম

গ্রাম-শহরের দোটানায় প্রণতি রাখলাম

সে আজ আমায় ডাক দিয়েছে আদ্যিকালের থেকে

চলো আমরা সেইখানে যাই এখনই প্রত্যেকে।

তোমার গ্রামকে তুচ্ছ করছি? তুলনা থাক, ছি!

সবার দেশই সবার ভাল- আমারটা পাকশী।

পাবনার ঈশ্বরদী থেকে পাকশী পনের মাইলও দূরে নয়। কাছেই পদ্মা নদী। বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১৯২৪ সালে স্থাপিত পাকশীর বিখ্যাত স্কুল চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এখন নামকরণ :বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এই স্কুলেই শঙ্খ ঘোষ মাট্রিক পর্যন্ত পড়েছেন। তার বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ বহুমান্য বাংলাভাষাবিদ। বিদ্যাপীঠের হেডমাস্টার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মণীন্দ্রকুমার ঘোষের সুসম্পর্ক, পত্রালাপ ছিল।

গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ দিকে শঙ্খ ঘোষ প্রাণের টানেই পাকশী, বিদ্যাপীঠ স্কুলে গিয়েছিলেন। দেখতে। স্কুলের মাস্টারকুল তাকে পেয়ে ধন্য। আর ছাত্রছাত্রী? আবদার কি ফেলতে পারেন? লেখেন 'আমার পাকশী'। ভেতর থেকে তাগিদে লেখা।

ছাত্রছাত্রী তার নিজেরই সন্তান যেন। স্নেহমমতা উজাড় করা ছিল অমলিন।

মনে পড়ছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে 'ইন্দিরা' সিনেমা হলে 'আমি, সে ও সখা' ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। বিস্ময় মানি। পেছনের সারিতে বসেছিলুম। দেখেননি। ছবি শেষে, বেরিয়ে আসার সময়ে দেখা। ছোট প্রশ্ন :'ভালো লেগেছে?'

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের এমএ পর্বে রবীন্দ্রনাথের 'পথের সঞ্চয়' পাঠ্য ছিল, প্রত্যেক শনিবারে ৪৫ মিনিটের ক্লাস। তিন মাস পড়িয়েছেন। ছাত্র ছিলুম। ছাত্রছাত্রীর প্রতিটি প্রশ্নে উত্তর, বিশদ ব্যাখ্যা। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন একালের বিবেক। সর্বার্থেই। আমরা ক্রমশ বিবেকহীন। আমাদের এতিম করে চলে গেলেন। আমরা অভিভাবকহারা।