সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন করে যুবক রায়হান আহমদকে হত্যা মামলার সাত মাসের মাথায় ওই ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় মহানগর হাকিম আদালতের ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাসের কাছে তা হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে অভিযোগপত্রটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্ঠার চার্জশিটে ৬ জনকে অভিযুক্ত করেছেন। 

অভিযুক্তরা হলেন- ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস, কনস্টেবল হারুন অর রশিদ ও কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লা আল নোমান। 

এদের মধ্যে এসআই হাসান আলী ও আব্দুল্লাহ আল নোমানকে তথ্য গোপন ও পালাতে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। তাদের কার কি ভূমিকা ছিল তাও উল্লেখ করা হয়। 

চার্জশিট দাখিলের পর বুধবার দুপুর ১২টার দিকে নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিং করেন পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির। এ সময় পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ্জামান ও তদন্ত কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, পিবিআই গত বছরের ১৩ অক্টোবর রায়হান হত্যা মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব নেয়। বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা, তত্ব-উপাত্ত বিশ্লেষণ, ৬৯ জনের সাক্ষ্য, রায়হানের সাথে পরের বিরোধ আছে কি-না নানা বিষয়ে তদন্ত করে চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে নোমান ছাড়া সবাই কারাগারে রয়েছেন। 

রায়হানকে কি হিসেবে চার্জশিটে দেখা হয়েছে-এমন বিষয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, রায়হানের সাথে পুলিশ ফাঁড়ির কারো কোনো পূর্ব বিরোধ ছিল না। তবে রায়হান ঘটনার দিন ইয়াবা কিনতে নগরীর কাষ্টঘরে যান। তিনি একজন অপরাধী। ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার মামলা ছিল। ২০১৮ সালে আরেকটি মাদক মামলা হয়। 

তিনি বলেন, রায়হান মারা যাওয়ার পর বন্দরবাজার পুলিশ তাকে ছিনতাইকারী বানাতে চেয়েছিল। ঘটনার দিন রায়হানের সাথে সাইদুর শেখ নামের আরেকজন ছিল। সে মূলত প্রতারক ও মাদক বিক্রির সাথে জড়িত। সেই প্রথমে পুলিশকে খবর দেয়। রায়হান ও সাইদুর কাষ্টঘরে একই উদ্দেশ্যে যায়। 

গত বছরের ১১ অক্টোবর মধ্যরাতে নগরীর কাষ্টঘর থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে আসা হয় নগরীর আখালিয়া নেহারি পাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে। ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরের নেতৃত্বে তার হাতের নখ তুলে নেওয়ার চেষ্টাসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। ওইদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে গুরুতর আহত অবস্থায় রায়হানকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেক ই এলাহীসহ পুলিশ সদস্যরা। সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে মারা যান রায়হান। কিন্তু হত্যার এ ঘটনাকে ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে রায়হান মারা যায় বলে পুলিশ দাবি করে সংবাদ প্রকাশ করে। পরে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে ঘটনার পরদিনই গা ঢাকা দেন আকবর হোসেন ভূঁইয়া। যাওয়ার সময় তিনি হাসান ও নোমানের সহায়তায় আলামত গায়েব করে যান। দীর্ঘ দিন পলাতক থাকার পর ভারত সীমান্ত থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। নোমান ছাড়া মামলায় চার্জশিটভুক্ত সব আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় ১২ অক্টোবর তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা তদন্ত চলাকালে বিভিন্ন পর্যায়ে একজন ইন্সপেক্টরসহ ৯ জনকে বরখাস্ত করা হয়। প্রথমে কোতোয়ালী থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত শুরু করে। কিছু দিন পর তা পিবিআই’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ ৭ মাসের মাথায় বুধবার আদালতে চার্জশিট দিল তদন্তকারী সংস্থা।

চার্জশিটে খুশি নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম। তিনি দ্রুত বিচার কাজ সম্পন্নের দাবি জানিয়েছেন। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম এ ফজল চৌধুরী জানান, অভিযোগপত্রে প্রাথমিকভাবে কোনো অসঙ্গতি মনে হয়নি। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর তা বলা যাবে।