- সারাদেশ
- শিল্পের অক্সিজেনে প্রাণরক্ষা
করোনাকালে সহমর্মিতা
শিল্পের অক্সিজেনে প্রাণরক্ষা
চট্টগ্রামের তিন শিল্প গ্রুপের উৎপাদিত অক্সিজেন বিনামূল্যে যাচ্ছে সারাদেশে

করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে আবুল খায়ের গ্রুপ (বাঁয়ে) ও জিপিএইচ গ্রুপ-সমকাল
ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও দেশে অক্সিজেনের হাহাকার নেই। অক্সিজেনের উৎপাদন বাড়িয়ে সারাদেশে প্রতিদিন শত শত করোনা রোগীর প্রাণ বাঁচাচ্ছে চট্টগ্রাম। বন্দর নগরীর তিনটি শিল্প গ্রুপ তাদের উৎপাদিত তরল অক্সিজেন বিনামূল্যে সরবরাহ করছে বিভিন্ন হাসপাতালে। জরুরি এ প্রয়োজন মেটাতে তারা উৎপাদনও বাড়িয়েছে। জিপিএইচ ইস্পাত প্রতিদিন গড়ে ২৫ টন তরল অক্সিজেন উৎপাদন করে বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। একইভাবে আবুল খায়ের স্টিল (একেএস) প্রতিদিন গড়ে ২২ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে স্বাস্থ্য খাতে। মোস্তফা হাকিম গ্রুপও তাদের ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে উৎপাদিত অক্সিজেন বিনামূল্যে সরবরাহ করছে করোনা রোগীদের কাছে। করোনার এ দুঃসময় যতদিন থাকবে, ততদিন এ সেবা চলবে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, মুমূর্ষু রোগীদের জন্য অক্সিজেন দরকার হয় খুব বেশি। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের সরবরাহ আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সাড়া দিচ্ছে চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপগুলোও। তাই ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ থাকলেও অক্সিজেনের সংকট তীব্র হয়নি এখনও। তবে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আমাদের অক্সিজেন প্লান্টগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে এখনই।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. আবদুর রব মাসুম বলেন, করোনার দুঃসময় দীর্ঘস্থায়ী হবে আরও। তাই তরল অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে আমাদের। এজন্য জরুরি কিছু সরঞ্জাম কিনতে হবে। বায়বীয় অক্সিজেনকে তরলে রূপান্তর করতে নতুন করে প্রয়োজনে প্লান্ট বসাতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লেগে যাবে। তাই কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
চাহিদা এখন দ্বিগুণ: স্বাভাবিক সময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অক্সিজেনের চাহিদা থাকে দৈনিক ১০০ টনের কাছাকাছি। করোনার কারণে এ চাহিদা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টনে। সংক্রমণের হার একটু কমতির দিকে থাকায় অক্সিজেনের চাহিদাও কমছে। তবে সংক্রমণ আবার বাড়লে প্রয়োজন বাড়বে অক্সিজেনেরও। দেশের স্বাস্থ্য খাতে সর্বাধিক অক্সিজেন সরবরাহ করে বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আছে ইসলাম অক্সিজেন, স্পেক্ট্রা অক্সিজেনসহ অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান। তবে শিল্প গ্রুপের অক্সিজেনকে স্বাস্থ্যে ব্যবহার উপযোগী করার দক্ষতা ও সক্ষমতা রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি লিনডে, স্পেক্ট্রাসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাই তাদের মাধ্যমে তরল অক্সিজেন বাজারজাত করে। তরলে অক্সিজেনের বিশুদ্ধতা থাকতে হয় কমপক্ষে ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। চট্টগ্রামের একেএস গ্রুপ ও জিপিএইচ গ্রুপের দুটি কারখানায় ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ মাত্রার অক্সিজেন উৎপাদিত হচ্ছে।
উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ: মেডিকেল অক্সিজেন সংকট নিরসনে উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে আবুল খায়ের গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান একেএস। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে একেএস প্লান্টে উৎপাদিত অক্সিজেন ২০২০ সাল থেকে জনস্বার্থে উন্মুক্ত করে দেয় আবুল খায়ের গ্রুপ। প্রতিদিন ২৬০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের বৃহত্তম এ অক্সিজেন প্লান্ট থেকে এতদিন তরল অক্সিজেন উৎপাদন হতো দৈনিক ১০ টন। ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ থাকায় এখন সেটি দ্বিগুণ করা হয়েছে। ১০ টনের স্থলে উৎপাদন করা হচ্ছে ২২ টন। এছাড়া ১০ হাজারেরও বেশি অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রতিনিয়ত রিফিল করে বিভিন্ন হাসপাতালে বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে তারা। উদ্বৃত্ত অক্সিজেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সরবরাহ করছে সারাদেশে। নিজস্ব উদ্যোগে ২০টি হাসপাতালে বিনামূল্যে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাও স্থাপন করে দিয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। গত ১৮ এপ্রিল থেকে উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে তা সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির সিইও মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ।

জিপিএইচ অক্সিজেন দিচ্ছে সর্ববৃহৎ প্লান্ট থেকে: দেশের সর্ববৃহৎ অক্সিজেন প্লান্ট আছে জিপিএইচ গ্রুপের। প্রায় ৩০০ টন ধারণ ক্ষমতার এ প্লান্টে এখন তরল অক্সিজেন উৎপাদন হয় দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ টন। ২৪০ থেকে ২৫০ টন উৎপাদন হয় বায়বীয় অক্সিজেন। ইস্পাত তৈরির কাঁচামালকে বিশুদ্ধ করতে অত্যাধুনিক এ অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করেছে তারা। ইস্পাতের প্রয়োজেন গড়ে তোলা অক্সিজেন প্লান্ট এখন বাঁচাচ্ছে অনেক মানুষের প্রাণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের এক ডজনের বেশি হাসপাতালে বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করছে তারা। উদ্বৃত্ত অক্সিজেন স্পেক্ট্রা কোম্পানির মাধ্যমে সারাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। তরল অক্সিজেনের উৎপাদন আরও বাড়ানোর সক্ষমতা আছে এ প্লান্টের। এজন্য নতুন লিকুইড প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতনরা। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উৎপাদন আরও বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তবে লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার তাদের। এটি পেলে তরল অক্সিজেনের উৎপাদন অল্প সময়ে বর্তমানের দ্বিগুণ করতে পারবে তারা।
কল দিলেই মিলছে মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশনের অক্সিজেন: করোনায় শ্বাসকষ্টের রোগীদের বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। গোল্ডেন ইস্পাত ও এইচএম স্টিল নামে এ গ্রুপের দুটি কারখানা রয়েছে। এ কারখানার জন্য ব্যবহূত হওয়া অক্সিজেন এখন মানবসেবায় ব্যবহার করছে তারা। প্রায় ৫০০ বোতল অক্সিজেন দিয়ে সেবা সংস্থাটি এ মানবিক কার্যক্রম শুরু করেছে। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে নিজস্ব প্রতিনিধি দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছে মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। কারও অক্সিজেন প্রয়োজন হলে ফাউন্ডেশনের সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিকে কল করতে হবে। এরপর তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হবেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যা বললেন: জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলাম বলেন, গত এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত হাজার টন তরল অক্সিজেন উৎপাদন করেছি আমরা। সীতাকুণ্ডের কারখানাটিতে আছে দেশের সর্ববৃহৎ অক্সিজেন প্লান্ট।
একেএস মিলের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ও কারখানা ইনচার্জ ইমরুল কাদের ভূঁঁইয়া বলেন, গত বছরের ১২ মে থেকে দৈনিক গড়ে ৫০০ সিলিন্ডার অক্সিজেন বিভিন্ন হাসপাতালে বিনামূল্যে দিচ্ছি আমরা।
মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক সিটি মেয়র এম মনজুর আলম বলেন, ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা নগরের ৪১টি ওয়ার্ড ও বিভিন্ন হাসপাতালে মোটরসাইকেলে বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন। বিভিন্ন উপজেলাতেও গত ১৪ এপ্রিল থেকে ১৫ জন প্রতিনিধির মাধ্যমে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরা স্থাপন করে দিয়েছি সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম। গাউছিয়া কমিটি ও আল মানাহিলের মাধ্যমেও অক্সিজেন বিতরণ করছি।
মন্তব্য করুন