পিছুটান নেই, সেবার ইচ্ছায় নির্বাচনে
স্বপন চৌধুরী, রংপুর ও ইজাজ আহ্মেদ মিলন, গাজীপুর
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৯
পরিজনের গঞ্জনা ও কটুকথা সইতে না পেরে প্রান্তিক সমাজে হয়েছে ঠাঁই। হাত পেতে পেট চলে। চাইতে গেলেও মেলে না। পদে পদে অবহেলা সয়েছেন। অপরাধ? লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিন্নতা। নারী-পুরুষের বাইরে আলাদা সত্ত্বা তাদের। শরীরের রূপ এক, আত্মার অন্য। সরকারের কাছে স্বীকৃতি মিলেছে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে। তবু সমাজ গ্রহণ করেনি আপন করে। এমন দু’জন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। দু’জনই বলেছেন, কোনো পিছুটান নেই তাদের। তাই মানবসেবার ইচ্ছায় নির্বাচনে এসেছেন।
তাদের একজন আনোয়ারা ইসলাম রানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রংপুর-৩ (সদর) আসনে। তিনি রূপান্তরকামী (ট্রান্সজেন্ডার)। অন্যজন ঊর্মি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত ঊর্মি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ, সদর ও সিটি করপোরেশনের একাংশ) আসনে। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। প্রার্থী হয়েছেন এ দলের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ইসলামিক জোটের হয়ে।
রংপুর নগরীর নূরপুর এলাকার বাসিন্দা চাঁন মিয়া-জুলেখা বেগম দম্পতির সন্তান আনোয়ারা ইসলাম রানী। ১৯৯২ সালে জন্ম তাঁর। পড়াশোনা করেছেন রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি রানী। ‘পুরুষ নাকি নারী আমি– প্রশ্ন সবার এক, আমি বলি, সবার আগে মানুষ হয়ে দেখ’– এ স্লোগান লালন করে গড়ে তুলেছেন সংগঠনটি। এর সদস্য সংখ্যা ১৫০ জনের মতো। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে জনগণের প্রশংসাও পেয়েছেন।
রানী ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বের করে এনেছেন ৩০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে। তারা নানা কাজের মাধ্যমে জীবিকার সংস্থান করেন। ১১ জন নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রানীর গড়া আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘রূপান্তর’। এখানেও কর্মরত ২৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
সমকালের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয় রানীর। তিনি বলেন, ‘আমি স্বাভাবিক জীবন পাইনি। অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি। যে কারণে সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ মানুষের কষ্টটা অন্য সবার থেকে ভালো বুঝি। সেই মানসিকতা থেকেই মানুষের কল্যাণে কাজ করছি।’ কিন্তু তা দিয়ে আর কতটুকু সম্ভব? সেই উপলব্ধি থেকে রংপুরের উন্নয়ন বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। তিনি মনে করেন, বড় কাজ করতে হলে নেতৃত্বে আসার বিকল্প নেই।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে গড়া সংগঠনকে নিজের পরিবার মনে করেন রানী। তাঁর যোগাযোগ রয়েছে মা-বাবা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গেও। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা রংপুরের এই আসনের মানুষ একটি দলকেই ভোট দিয়ে আসছি। ভোটের পর নির্বাচিত এমপিকে কাছে পায় না মানুষ। শুধু নেতৃত্বের অভাবেই উন্নয়ন থেকে রংপুর অনেক পিছিয়ে আছে।’
নানা কারণেই আলোচিত রংপুর-৩ (সদর) আসনটি। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনের সংসদ সদস্য পদে আছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ। তবে আসন্ন নির্বাচনে তাঁকে সরিয়ে প্রার্থী হয়েছে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়েছেন তুষার কান্তি মণ্ডল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মোট ৯ প্রার্থী। তাদের একজন আনোয়ারা ইসলাম রানী।
সব ক্ষেত্রে রংপুর অবহেলিত হয়ে আসছে বলে মনে করেন রানী। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নমূলক মহাপরিকল্পনা থেকে রংপুর বরাবরই বঞ্চিত। নেতা আসে নেতা যায়; কিন্তু এখানকার উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা নেই। যে কারণে তিনি এ আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নেতৃত্বে আসতে চান।
সমাজের অন্য মানুষের যেখানে সংসার-সন্তান নিয়ে চিন্তা, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা– সেখানে কোনো পিছুটান নেই আনোয়ারা ইসলাম রানীর। তিনি বলেন, ‘জন্মস্থান রংপুরের মানুষই আমার সংসার, তারাই আমার পরিবার। আমি সবার আপন হতে চাই। সবার সঙ্গে মিলেমিশে এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে চাই।’
তৃতীয় লিঙ্গের পাশাপাশি দলিত, হরিজন, বেদে ও আদিবাসীদের কৌশলে পিছিয়ে রাখা হয়েছে বলে মনে করেন রানী। তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে রংপুরে কৃষিভিত্তিক কলকারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হবেন। এতে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ পাবে। এ ছাড়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও ১০টি সরকারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তিনি। রানীর পরিকল্পনায় রয়েছে– নগরীর শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার করে আধুনিক লেকে রূপান্তর ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদার করা। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত রংপুর গড়তে তিনি ২১ দফা প্রতিশ্রুতি দেন।
গাজীপুর মহানগরের পূবাইল থানাধীন বাড়ৈবাড়ি গ্রামের ফাইজ উদ্দিন খান-সালেহা খাতুন দম্পতির ১০ সন্তান। তাদের মধ্যে সবার ছোট ঊর্মি ভান্ডারি। তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করায় নানা যন্ত্রণায় কাটিয়ে চলেছেন জীবন। অবহেলা-বঞ্চনার পাশাপাশি লাঞ্ছনাও সঙ্গী তাঁর। গাজীপুর-৫ আসনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে চান সমাজ থেকে এসব দূর করার প্রত্যয় নিয়ে।
গাছা দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন ঊর্মি। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। দলের প্রতীক একতারায় আসন্ন নির্বাচনে ভোট চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এ আসনে আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। এ দু’জনসহ ৯ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ঊর্মি বলেন, ‘মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সমাজের অবহেলিত, লাঞ্ছিত, দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ নিজে যে যন্ত্রণা সয়ে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন, সেই সমাজটা বদলে দেওয়াই লক্ষ্য ঊর্মির।
এ বিষয়ে কথা হয় ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অসীম বিভাকরের সঙ্গে। তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সমাজে নানারকম অবহেলা-অবজ্ঞার মধ্যদিয়ে বড় হন, বেঁচে থাকেন; জীবনযাপন করেন। তাদের প্রতি সমাজের অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গী নেতিবাচক। জাতীয় নির্বাচনে সাহস করে দুই প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। এটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে, ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে সহায়তা করবে।