
জহুরুল ইসলাম
প্রতিটি কাজেই থাকে গলদ। আছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। সক্ষমতা না থাকলেও বাগিয়ে নেন বড় বড় প্রকল্পের কাজ। কাজ পেতে তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ম্যানেজ ও কমিশন হিসেবে দেন মোটা অঙ্কের অর্থ। এই ঠিকাদারের নাম জহুরুল ইসলাম। তিনি জহুরুল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী। কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলায় তার দাপট রয়েছে।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন (সিজিএম), নার্সিং কলেজ ভবন ও কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজে জহুরুল ইসলাম ঠিকাদার ছিলেন। এর বাইরে বর্তমানে কুষ্টিয়া শহর চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রায় ২৪০ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। আর কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণের এক বছর না গড়াতেই তার অবস্থা বেহাল। মেডিকেল কলেজ ভবনের ছাদ ধসসহ প্রতিটি কাজেই তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে জহুরুল ইসলাম দাবি করেন, খারাপ কাজ তিনি করেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় শতকোটি টাকার কাজটি কমিশনের মাধ্যমে পান জহুরুল ইসলাম। তিনি ২০১৫ সালে হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ওই ভবনের ছাদ ধসে মারা যান একজন শ্রমিক। এরপর তদন্তে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের প্রমাণ মেলে। ২০১৯ সালের ৪ মার্চ দুই বছরের জন্য তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। পুরো কাজ শেষ না হলেও তিনি ৯৭ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করেছেন। ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া সিজিএম আদালত ভবন নির্মাণকাজটি করা হয়। তবে দীর্ঘসময় পার হলেও ষষ্ঠ থেকে অষ্টম তলা এখনও হস্তান্তর করা হয়নি। এখানেও নানা অনিয়ম হয়েছে বলে গণপূর্ত অফিস সূত্র জানিয়েছে। কুষ্টিয়া নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজও পান ঠিকাদার জহুরুল। ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকলেও ভবনটি এখনও হস্তান্তর করা হয়নি।
গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এ ঠিকাদার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাজের শর্ত মানেন না। কাজের মান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। ঠিকাদার হিসেবে তার সক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে নানা প্রকল্পে দুর্বলতার বিষয়টি ধরা পড়েছে।
শুধু গণপূর্তে নয়, কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগেও জহুরুল ইসলামের রয়েছে আধিপত্য। তিনি জেলার মধ্যে বড় কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়ক সংস্কার ও বর্ধিতকরণ প্রকল্পের কাজটি তিনিই করেন। কাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। অনিয়মের কারণে দীর্ঘসময় এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। ২০১৯ সালের এ সড়কের বেশ কিছু অংশ বৃষ্টিতে ভেঙে যায়। পরে তড়িঘড়ি তা সংস্কার করা হয়। নতুন করে কুষ্টিয়া-কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডে সমতল সড়ক উঁচু-নিচু হয়ে গেছে।
জানা যায়, জহুরুল ইসলাম কাজ পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও একজন মন্ত্রী তার কাছের এমন কথা বলে তিনি প্রভাব বিস্তার করেন। আর প্রতিটি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তিনি নানাভাবে ম্যানেজ করেন।
ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-পাকশী-দাশুড়িয়া মহাসড়কের কুষ্টিয়া শহরাংশ চার লেনে উন্নীতকরণসহ অবশিষ্ট অংশ যথাযথমানে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পাঁচটি লটে এই কাজ বাস্তবায়ন হবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে মজমপুর রেলগেট পর্যন্ত তিনটি লটের কাজ পেয়েছে জহুরুল লিমিটেড। পাঁচ নম্বর লটের টেন্ডার এখনও শেষ হয়নি। সেটাও নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন জহুরুল। তার আগে পাওয়া অংশে কাজের ব্যয় ধরা আনুমানিক ২৪০ কোটি টাকা। এ কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয় ২০২০ সালে। টেন্ডারে সেই সময় জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক নেতা এবং সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কাজ বাগিয়ে নেন। কাজের মান নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের সামগ্রী, নষ্ট ইটের খোয়া ও ভেজাল বিটুমিন দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ভাদালিয়া থেকে বটতৈল পর্যন্ত এক দফা কাজ শেষ হয়েছে। আর চৌড়হাস থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত কাজ চলমান। এর বাইরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলামপুর পর্যন্ত সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, চার লেনের কাজের মান খুবই খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে ঠিকাদার জহুরুলের কাজে অনিয়ম হচ্ছে। অফিসের কোনো কর্মকর্তা সেখানে যান না। তারা ইচ্ছামতো কাজ করছে।
বটতৈল এলাকায় জহুরুল ইসলামের স্টক ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহূত নিম্নমানের ইট ভাঙছে শ্রমিকরা। হাতুড়ির বাড়ি পড়তেই গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে খোয়া। এসব খোয়াই ফোর লেনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। শ্রমিকদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, এসব ইট কোথা থেকে আনা হয়, তা জানেন না।
ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক নেতা বলেন, জহুরুলের কাজ নিয়ে বারবার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের কাজ করা হচ্ছে। বালু বেশি দিয়ে পাথর কম দিচ্ছে। ভেজাল বিটুমিনও দেওয়া হচ্ছে। এসব চলছে চোখের সামনেই।
কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, চোখের সামনে যেসব সামগ্রী দিয়ে কাজ হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তদন্ত হলে সব অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।
কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, জনগণের টাকায় সড়ক হচ্ছে। কুষ্টিয়াবাসী কোনো অনিয়ম মেনে নেবে না। ঠিকাদাররা চুরি করবেই। তাদের চুরি ধরার যাদের দায়িত্ব তারা কেন চুপ? এটাও খতিয়ে দেখতে হবে, কীভাবে তারা কাজ পায়?
কুষ্টিয়া জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, কালো তালিকাভুক্ত হওয়া ঠিকাদারই আবার জেলার বড় বড় প্রকল্পে কাজ করছে। বিষয়টির অবশ্যই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এখন যেসব প্রকল্পে কাজ করছেন, তার মান সঠিক হচ্ছে কিনা, তাও দেখা দরকার।
এসব অভিযোগ বিষয়ে জহুরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার ফোন দেওয়ার পরও তিনি ধরেননি। এর পর তাকে মেসেজ দেওয়া হলেও কোনো উত্তর দেননি। অবশেষে তার বক্তব্য জানতে তার প্রতিষ্ঠানের বটতৈলের অফিসে যাওয়া হয়। সেখান থেকে অফিসের কর্মকর্তারা জানান, তিনি ঢাকায় আছেন।
মঙ্গলবার কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাকিরুল ইসলামের অফিস রুমে ঠিকাদার জহুরুল ইসলামের দেখা মেলে। অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের সামান্য একটি অংশে সমস্যা হয়েছে। সেখানে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এমনটি হচ্ছে। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন বিষয়ে বলেন, প্রকল্প নিয়ে ঝামেলার মধ্যে আছি। চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেছি। ২০১৫ সালের টেন্ডারে কাজ করেছিলাম। অনেক লোকসান হয়েছে। এ প্রকল্প নিয়ে কিছু বলার নেই। সিজিএম আদালত ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার কাজ শেষ করে দিয়েছি। পঞ্চম তলা পর্যন্ত আগেই হস্তান্তর করেছি।
বতর্মানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মজমপুর গেট পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও ফোর লেনের কাজে অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে জহুরুল ইসলাম উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, কোন অনিয়ম হচ্ছে? হাজার হাজার ইটের মধ্যে দু-একটি খারাপ থাকতেই পারে। কাজের মান ঠিক রেখেই কাজ করি।
জহুরুল ইসলামের সামনেই সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাকিরুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে তোলা প্রকল্পে ব্যবহূত নষ্ট ইটের ছবি দেখানো হয়। তিনি বলেন, এসব ইট চলবে না। ওই ইট বাতিল করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, কোনো ঠিকাদার অনিয়ম করলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফোর লেনের কাজের মান যাতে ভালো হয় সে জন্য মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। ঠিকাদার জহুরুল ইসলাম অন্য কোথায় কী করেছেন, তা আমাদের জানা নেই।
মন্তব্য করুন