চলতি মৌসুমে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের নস্করীপাড়ার ফাহিমা বেগম ৭৫ শতক জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদন করেন। তার মোট সবজি উৎপাদন ৪৯ মণ। যা গত বছরের মোট উৎপাদনের তুলনায় দ্বিগুণ। গত পাঁচ বছরে ৩৩ শতক জমি কিনেছেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের ধুবনী কাঞ্চিবাড়ীর জাহেনূর বেগম। তৈরি করেছেন নতুন বাড়িও। কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে তারা দুজনেই আঞ্চলিক পাইকারদের কাছে এসব সবজি বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন ব্যবসার।

অথচ কয়েক বছর আগেও ফাহিমা ও জাহেনূরের কিছুই ছিল না। অভাব-অনটনের সংসারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতেন তারা। আজ স্বাবলম্বী। কারণ, ২০১৬ সালে অ্যাকশান এইড বাংলাদেশের একটি প্রকল্পে যুক্ত হন তারা। ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)’ নামে এ প্রকল্পের গাবতলী উপজেলার বাস্তবায়নকারী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনমিক অ্যাডভান্সমেন্ট অব বাংলাদেশ (আসিয়াব) ও গাইবান্ধায় এসকেএস ফাউন্ডেশন বাজারজাতকরণ এবং কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে তারা উদ্যোক্তার করণীয়, উৎপাদন কৌশল এবং বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন। এসব প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের ভাগ্য বদল ঘটে।

এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নেওয়া অনেক নারী উদ্যোক্তারা জানান, নারীদের বাজারে প্রবেশাধিকার নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না। দালাল ধরে পণ্য বাজারে পাঠালে লাভ বলতে কিছু থাকে না। দেখা যায়, ৩০ টাকার লাউ বিক্রি করে দিতে হয় ১০-১৫ টাকায়। ন্যায্যমূল্যও পাওয়া যায় না। তাই নিজেরাই সরাসরি কালেকশন পয়েন্ট ও বাজার সেডে বসে সবজি বিক্রি করেন।

ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়ে বগুড়ার নুরজাহান বেহগম, আছিয়া, গলাচিপার উদ্যোক্তা পারুল বেগম জানান, নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। তারা আয় করছেন বলেই পরিবারে এখন বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছেন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সেইসঙ্গে পরিবারিক সহিংসতা হ্রাস পেয়েছে।

সরকারি এক পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ৪৭ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সূত্রে জানা যায়, কৃষিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মজীবী মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। নারী কর্মজীবীদের মধ্যে কৃষিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী যুক্ত থাকায় অর্থনীতিতে নারী কৃষকদের ভূমিকা ব্যাপক।

তবে, কৃষক, খামারি বা মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে চিন্তা করলে নারীর কথা কেউ চিন্তা করেন না। ভূমির মালিকানা না থাকায় সরকারি সুবিধা, কৃষি কার্ড, ভর্তুকি, ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা পান না নারী। ব্যক্তি উদ্যোগে ফসলের জন্য জমি লিজ ও বর্গা নেওয়ার ক্ষেত্রে চুক্তি হয় পুরুষের সঙ্গে। ফলে এক পরিবারের দুজনে মিলে কাজ করলেও পুরুষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই কৃষি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন নারী। বিপণনব্যবস্থায় নারীকে সম্পৃক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর ওপর জোর দিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থার বাস্তবতা সামনে রেখেই অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ) নামের একটি প্রকল্পটি চালু করে। প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে পটুয়াখালীর গলাচিপা, ফরিদপুরের সদর ও মধুখালী, বগুড়ার গাবতলী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়। বিদ্যমান গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থায় টেকসই ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য। একইসঙ্গে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাকে নারী-বান্ধবকরণের লক্ষ্যে স্থায়ী ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধন, লক্ষিত নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগী মনোভাবাপন্নতা বৃদ্ধি করা এবং লক্ষিত নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিমানের উন্নয়ন সাধন করা যাতে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। প্রকল্প কর্ম এলাকায় ৬০০২ জন নারী কৃষি উদ্যোক্তা, ৩০টি ইউনিয়ন, ৩০টি বাজার কমিটি, ৩০টি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করে।

প্রকল্পের সিনিয়র অফিসার-অ্যাডভোকেসি জাকিরুল ইসলাম পিটার সমকালকে জানান, প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনে গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য সহজে বিক্রয় নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি পর্যায়ে ৭৬টি কালেকশন পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে নারীদের প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য বাজারে নারী-বান্ধব ২২টি মার্কেট সেড নির্মাণ করা হয়েছে। ওইসব কালেকশন পয়েন্ট ও মার্কেট সেডগুলোতে নারীদের সুবিধার্থে টয়লেট, নলকূপ, ব্রেষ্ট ফিডিং কর্ণারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে তাদের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা এবং তাদের ও তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি মানের উন্নয়ন সাধন করার জন্য ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাদের প্রবেশকে সহজ করার নিমেত্তে এমএমডব্লিওডব্লিও প্রকল্প ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কমিউনিটি ভলান্টিয়ার হিসেবে গড়ে তোলে। প্রকল্পের ৩১ জন কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গ্রামীণ নারী কৃষি উদ্যোক্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সেবা প্রদান করার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে বিকল্প সরবরাহ চ্যানেল চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা পরিবার পর্যায়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি উপর সচেতসতামূলক সেশন পরিচালনা করছে, নিয়মিত বাচ্চাদের উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করছে, পাঁচ বছরের নীচের বয়সের বাচ্চাদের এমইউএসি পরিমাপ করছে। পাশাপাশি তারা গ্রামীণ নারীদের প্রেসার মাপছেন এবং সেনিটারী নেপকিন, সেলাইন, নিত্য প্রয়োজনীয় ঔষধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলসহ স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত অন্যান্য সামগ্রী সুলভ মূল্যে বিক্রয় করে নিজেদের কর্মসংস্থান করছেন এবং উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

জানা যায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কর্ম এলাকার ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অবহিতকরণ সেশন পরিচালনা করেন। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেেয়ছে। এর পাশাপাশি স্কুলগুলোতে ১৩টি ‘এসআরএইচআর’ কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বই, লিফলেট, পাফলেট ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা সেগুলো পড়ছে। এসব কর্ণারের মাধ্যমে সেনিটারি নেপকিনসহ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। যা শ্রেণিকক্ষে কিশোরী শিক্ষার্থীর গড় উপস্থিতির উপর ইতিবাচক প্রভার ফেলেছে। শিক্ষকও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি এ বিয়য়টিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং তারা এসআরএইচআর কর্ণার চালু রাখার বিষয়ে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য অঙ্গীকার করেছেন।

প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী ড. শওকত আকবর ফকির বলেন, প্রকল্পটি গ্রামীণ পর্যায়ে কর্ম এলাকায় বিদ্যমান বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনয়নে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাকে আরও গতিশীল করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সম্প্রসারণমূলক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি। তিনি জানান, এ প্রকল্পের শিখন হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদই পারে তার ইউনিয়নের বাজারগুলোকে নারীবান্ধব বাজার হিসেবে গড়ে তুলতে। যদি নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যাবস্থার উন্নয়ন করা যায়, তাহলে তার মানসিক শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। যা অধিক হারে তাকে আয়মূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে সহায়তা করে। উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পেলে গ্রামীণ নারীরাও উন্নতমানের নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন।

দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলা গলাচিপা। এখানে নারীরা দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সহজে ঘরের বাহির হতে চান না। গলাচিপা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয়েছে মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন প্রকল্প। এ প্রকল্প এলকায় প্রধানত তিনটি পণ্যের ভ্যালূ চেইন নিয়ে কাজ করা হয়েছে। পান, মুগ ডাল এবং সবজি। জানা যায়, মুগ ডাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মুগ ডালের বৃহৎ ক্রেতাদের সাথে যুক্ত আছেন। কালেকশন পয়েন্ট ব্যবহার করে নারী উদ্যোক্তারা তাদের মুগ ডাল বিক্রয় করে থাকেন। এতে তাদের পরিবহন খরচ এবং সময় দুই সাশ্রয় হয়। বাড়ীর কাছে কালেকশন পয়েন্ট হবার ফলে নারী উদ্যোক্তারা অল্প পরিমাণে উৎপাদিত পন্যও বিক্রয় করতে পারছেন। এতেও নারী উদ্যোক্তাদের সময় ও আর্থিক সাশ্রয় হয়েছে।

গলাচিপায় উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের এমএমডাব্লিউডাব্লিউ প্রকল্প সমন্বয়কারী শঙ্কর কুমার দাশ বলেন, ‘নারীরা বাৎসরিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরী করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা নিয়মিত হিসাব সংরক্ষণ করছেন। পঞ্চাশ ভাগ নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক লাইসেন্স রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারী উদ্যোক্তাদের অধিক পরিমাণে ঋণ দিচ্ছেন।’