কভিড-১৯ মহামারির কারণে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সত্ত্বেও এর সর্বজনীনতা ও কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। 
সম্প্রতি ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, 'ছাত্র-শিক্ষক সবার টিকা প্রাপ্তি বা করোনা সংক্রমণ শূন্যে নামার অপেক্ষায় না থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন।' বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা মহামারির কারণে এক নাগাড়ে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ ও হতাশায় ভুগছে। মনে রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু সিলেবাস ভিত্তিক পাঠ গঠন ও পরীক্ষার পাস দেওয়ার জায়গা নয়; বরং শিক্ষার্থীদের মেধা গঠনের লালন করার পাশাপাশি সামগ্রিক ও মানসিক বিকাশ এবং সামাজিকায়নের উৎকৃষ্ট স্থান। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারে, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার মনোভাবের সমন্বয় ঘটাতে পারে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা চর্চার সুযোগ পায়, সর্বোপরি বন্ধুত্ব-সহানুভূতির মতো মানসিক আবেগগুলো চর্চা করতে পারে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, যা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্নিষ্ট অংশীজনের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা-সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা একান্ত প্রয়োজন। 
করোনাকালীন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এবং শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিভিন্ন সময়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই অনলাইন পাঠদানকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমও চলছে। এতদসত্ত্ব্বেও নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন ব্যাহত হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। 
কভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব সক্ষমতা ও বাস্তবতা অনুযায়ী একটি রিকভারি প্ল্যান তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক একটি গাইডলাইন্স ইতোমধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই রিকাভারি প্ল্যান তৈরির ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি নিল্ফেম্ন তা উল্লেখ করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সময়কাল উল্লেখযোগ্য ও গ্রহণযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে হবে; তবে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাসের সময় ও সিলেবাস কমানো যাবে না। সেমিস্টারের ক্ষেত্রে ৬ মাসের কোর্স ৪ মাসের মধ্যে এবং বার্ষিক টার্ম পদ্ধতির ক্ষেত্রে ১ বছরের কোর্স ৮ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ একটি প্রোগ্রামের ৪০টি কোর্স ৩ ক্রেডিট করে ১২০ ক্রেডিট হয়ে থাকে। যদি প্রতি সেমিস্টারে মোট কোর্সের সংখ্যা ৫টি হয় তবে ক্রেডিট হবে ৩ী৫ = ১৫। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি ক্রেডিটের জন্য ১৫ ঘণ্টার ক্লাস প্রয়োজন। সে হিসাবে প্রতি সেমিস্টারে ক্লাসের সময়কাল ১৫ী১৫ = ২২৫ ঘণ্টা হবে। বর্তমানে প্রচলিত সপ্তাহে প্রতি কোর্সে দেড় ঘণ্টা করে দুটি ক্লাসের পরিবর্তে তিনটি করে ক্লাস নেওয়া হলে পাঁচটি কোর্সের ক্লাসের জন্য সময় লাগবে ৪.৫ী৫ = ২২.৫ ঘণ্টা। ফলে সেমিস্টারপ্রতি মোট ক্লাসের জন্য প্রয়োজন হবে ১০ সপ্তাহ। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রিপারেটরি লিভ ১ সপ্তাহ এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফলাফল প্রকাশের জন্য ৫ সপ্তাহ নির্ধারণ করা হলে মোট ৪ মাসের মধ্যে একটি সেমিস্টার শেষ হবে। একইভাবে বার্ষিক/টার্ম পদ্ধতির ক্ষেত্রে ক্লাসের জন্য ২০ সপ্তাহ, পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রিপারেটরি লিভ ২ সপ্তাহ এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফলাফল প্রকাশের জন্য ১০ সপ্তাহ নির্ধারণ করা হলে মোট ৮ মাসের মধ্যে তা সম্পন্ন হবে। কারিকুলামে যদি মিডটার্ম পরীক্ষার বিধিবিধান থাকে তাহলে সেমিস্টারের ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ ক্লাস নেওয়ার পর এবং বার্ষিক/টার্ম পদ্ধতির ক্ষেত্রে ৮ সপ্তাহ ক্লাস নেওয়ার পর মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সময় কমানোর স্বার্থে বিভিন্ন ছুটি কমানো, দুটি বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে গ্যাপ কমানো ও ক্লাস টেস্ট-কুইজ-অ্যাসাইনমেন্ট-টার্ম পেপার-প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা-মৌখিক পরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি রিকভারি প্ল্যান তৈরি করে তা একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই অনুমোদিত একাডেমিক ক্যালেন্ডার শিক্ষার্থীদের অবহিত করে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং প্রণীত একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে পরপর দুই বছর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি অনেকাংশে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব অংশীজনের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। 
করোনার বর্তমান ঊর্ধ্বগতি প্রশমিত হলে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতোমধ্যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ও আবাসিক হলগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বিশেষ বরাদ্দের আওতায় সম্পন্ন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে রিকভারি প্ল্যান তৈরিপূর্বক এর বাস্তবায়নের কৌশল এখনই নির্ধারণ করে রাখতে হবে যাতে সময় নষ্ট না হয়। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি শিক্ষাবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। আশা করি সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিগগির শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্টম্ফূর্ত পদচারণায় আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে।
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন