
প্রতীকী ছবি
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৪ বছরের এক কিশোরী। পাশবিক নির্যাতনে অচেতন হয়ে পড়া মেয়েটিকে সেদিন রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন প্রতিবেশীরা। এরপর চিকিৎসায় শরীরের ক্ষত সারলেও মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল হয়নি। এর মধ্যে নানাজনের মুখে 'খারাপ মেয়ে' আখ্যা পেয়ে সে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও চালিয়েছে। নিজেই নিজের হাত কেটেছে 'লোকলজ্জা' থেকে বাঁচতে। লোকজনের কটুকথার ভয়ে বাসা বদল করেছেন কিশোরীর বাবা। অন্যদিকে, ধর্ষণে অভিযুক্ত তরুণরা জামিনে বেরিয়ে সদর্পে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তাদের বন্ধু-স্বজনরা অকথ্য গালাগাল করে হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত মেয়েটির পরিবার।
কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলপুর এলাকার একটি দোতলা ভবনের ছাদে গত বছরের ৯ জানুয়ারি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ওই ঘটনা ঘটে। এতে কিশোরীর এক বান্ধবীও জড়িত ছিল। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা করেন। তার আগেই ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে র্যাব পলাতক অপর আসামিকেও সাভার থেকে গ্রেপ্তার করে। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। হুমকি দেওয়া বা হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবা পেশায় রংমিস্ত্রি। তিনি সমকালকে জানান, অভাব-অনটনের সংসার হওয়ায় মেয়েকে একটি টেইলার্সে কাজ করতে দিয়েছিলেন। তবে ওই ঘটনার পর তার মেয়ে এখন বাইরে যেতে ভয় পায়। সারাক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে বাসায় বসে থাকে। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনও তাকে তাড়া করে ফেরে। সে কারও সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না, মেশে না। মাঝেমধ্যে পাগলের মতো আচরণ করে। সবকিছু ভাঙচুর করে। এর মধ্যে প্রতিবেশী ও পরিচিতদের কেউ কেউ ধর্ষণের ঘটনার জন্য মেয়েটিকেই দায়ী করে নানারকম আজেবাজে কথা বলে। এতে মেয়েটি মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যরাও লোকজনের সঙ্গে মিশতে অস্বস্তি বোধ করেন। পরিচিত লোকদের এড়াতে একবার বাসাও বদল করেছেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের ঘটনার কিছুদিন আগে রতন নামে এক তরুণ মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। তবে সে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এতে তরুণ ক্ষিপ্ত হয়ে 'দেইখা নিমু' বলে হুমকি দিয়েছিল। পরে রতন তার বন্ধু হাসান, রনি, সবুজ ও সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। তাদের মধ্যে হাসানের সঙ্গে ভুক্তভোগী কিশোরীর অপ্রাপ্তবয়স্ক এক বান্ধবীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সে পাওনা টাকা আদায়ে সহায়তার কথা বলে কিশোরীকে ডেকে নেয়। এরপর তাকে পূর্ব রসুলপুরের একটি গলিতে রেখে চলে যায়। সেখানে রতন ও তার দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কিশোরীকে ধরে নিয়ে যায় পাশের জুতা কারখানার দোতলা ভবনের ছাদে। তারা আরও দু'জনকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসে। এরপর পাঁচজন মিলে ধর্ষণ করে। চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন গিয়ে দুই তরুণকে আটক ও মেয়েটিকে নগ্ন অবস্থায় উদ্ধার করে। তাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়।
ভুক্তভোগী মেয়েটির বাবা জানান, জড়িত ছয়জনকেই পুলিশ-র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। তবে নয় মাস কারাগারে থাকার পর তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর থেকেই তাদের বন্ধু ও স্বজনরা নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। মাসখানেক আগে রসুলপুর কালভার্টের অদূরে গলিতে তার পথরোধ করে একদল তরুণ। তারা বলে, 'পারলেন না তো আটকায় রাখতে? বেশি বাড়াবাড়ি কইরেন না। চুপচাপ মামলাটা উঠায় নিবেন। নাইলে এলাকায় থাকতে পারবেন না।' বিষয়টি তিনি পুলিশের তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন।
এদিকে, হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ধর্ষণে অভিযুক্ত রতন। সে সমকালকে বলেছে, 'আমরা কোনো হুমকি দিইনি। উল্টো মেয়ের বাবা আমাদের কাছে আড়াই লাখ টাকা চেয়েছে। টাকা পেলে তিনি মামলা তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন।' এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা বলেন, 'আমি সাধারণ দিনমজুর। কিন্তু টাকা নিয়ে মেয়ের ওপর হওয়া অত্যাচারের বিচার বন্ধ করার মতো পিশাচ না। আর টাকা নিলে তো আগেই নিতে পারতাম। এতদিন পর কেন টাকা চাইব?'
অভিযুক্তদের মধ্যে সিফাতের নম্বরে ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। বাকি তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য করুন