বরিশালে গত ১৮ আগস্ট সহিংসতার পর স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ছে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের। ক্রমেই বাড়ছে তার অনুসারী। সর্বশেষ গত রোববার সিটি করপোরেশনের ৯ কাউন্সিলর ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছেন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। কাউন্সিলরদের মধ্যে পাঁচজন গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে যুক্ত হন। নতুন করে তাদের সঙ্গে একাট্টা হয়েছেন চারজন। প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে আরও অর্ধডজন কাউন্সিলর যুক্ত হবেন- এমন দাবি করেছে সংশ্নিষ্ট সূত্র। গত ২৯ আগস্ট জেলা আওয়ামী লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতিও হঠাৎ করে ওঠেন প্রতিমন্ত্রীর মঞ্চে। সব মিলিয়ে মেয়র-ইউএনও কাণ্ডের পর কিছুটা নিষ্প্রভ বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠছে।
প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক মহানগর ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনের এমপি হলেও তার রাজনৈতিক পদচারণা শুরু থেকেই নীরবে-নিভৃতে। নগরের রাজনীতিতে একক নিয়ন্ত্রকের আসনে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং স্থানীয় জনপ্রতিধিরা অদৃশ্য কারণে প্রতিমন্ত্রীর কাছে যেতেন না।
সহিংস ঘটনার পর প্রশাসনের সঙ্গে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সৃষ্ট দূরত্বে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। মেয়র ২৭ আগস্ট থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার অনুসারী নেতাকর্মীরাও চুপচাপ।
গত ১৮ আগস্ট রাতে সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে সিটি করপোরেশনের কর্মী পরিচয়ে প্রতিমন্ত্রীর ব্যানার ফেস্টুন অপসারণ করতে গেলে ইউএনওর বাসভবনে হামলা, আনসারদের গুলিবর্ষণ এবং পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মেয়র অনুসারী নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে বড় ধরনের হোঁচট খায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ইউএনও-পুলিশের মামলায় মেয়রসহ তার অনুসারীরা আসামি হয়ে এখনও অনেকটা কোণঠাসা। এ প্রেক্ষাপটে ৯ কাউন্সিলর ঢাকায় গিয়ে সংসদ ভবনে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের একাধিক ছবি সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেলে নতুন করে আলোচনায় আসে এখানকার রাজনীতি।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া কাউন্সিলররা হলেন- ১ নম্বর ওয়ার্ডের আমীর বিশ্বাস, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৌহিদুল ইসলাম বাদশা, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ভুলু, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জিয়াউর রহমান বিপ্লব, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান দুলাল, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের এনামুল হক বাহার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শরীফ মো. আনিসুর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের হুমায়ন কবির এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদ আহম্মেদ।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে একাধিক কাউন্সিলর বলেন, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল স্থানীয় রাজনীতি ও উন্নয়ন। প্রতিমন্ত্রী মহানগরে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করাসহ নগর ও সদর আসনের উন্নয়নে কাউন্সিলরদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আধিপত্যের মানসিকতা পরিহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের বার্তা নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাউন্সিলরদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
কাউন্সিলর আনিছুর রহমান দুলাল বলেন, 'আমরা মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অসহযোগিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। বরিশালে যে গুমোট রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছিল, এর পরিবর্তন করা যায় কি-না এবং সাংগঠনিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। কারও সঙ্গে কোনো সংঘাতে আমরা যাব না।' দুলাল আরও বলেন, 'বিএনপির লোকজন নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছে। অথচ আমরা দলে ভালো জায়গা পাই না।'
কাউন্সিলর শরীফ আনিছুর রহমান বলেন, 'আমরা কারও বিরুদ্ধে যাইনি। দলের স্বার্থে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। যেখানে সম্মান পাওয়া যায় না, পদে পদে হেনস্তা হতে হয়, সেই বলয়ে থেকে লাভ কী? শুধু আমরাই নই, আরও প্রায় অর্ধডজন কাউন্সিলর যোগ দেবেন প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে।'
কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার বলেন, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীদের সম্মান নেই। গত তিন বছরে আমরা দলীয়ভাবে মর্যাদা পাইনি। কাউন্সিলর জাকির হোসেন ভুলু বলেন, জাহিদ ফারুক স্থানীয় সাংসদ। তার কাছে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়।
১৮ আগস্ট রাতের ঘটনার সময় ঢাকায় থাকলেও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক ২৮ আগস্ট থেকে তিন দিন বরিশাল সফর করেন। একাধিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলেও ১৮ আগস্ট রাতের ঘটনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। অন্যদিকে জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতারা আগের মতোই প্রতিমন্ত্রীর কর্মসূচিতে যাননি।
তবে ২৯ আগস্ট চরমোনাই ইউনিয়নে প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগে সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বক্তৃতায় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ আনিসুর রহমান বলেন, বরিশালের রাজনীতি সন্ত্রাসনির্ভর হওয়ায় তিনি স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। প্রতিমন্ত্রীর শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে থেকে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস সমকালকে বলেন, 'জাহিদ ফারুকের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।'
৯ কাউন্সিলের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাদের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তারা অবহেলিত। তাদের কথা শুনেছি এবং দল ও উন্নয়নের স্বার্থে পাশে থাকার কথা বলেছি।
মেয়র অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল ইসলাম লিটু প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কাউন্সিলরদের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে বলেন, যারা সাক্ষাৎ করেছেন, তারা দলের পুরোনো কর্মী। এতে দোষের কিছু নেই।
মেয়রের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :ক্ষুব্ধ কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী কাউন্সিলরদের নিয়ে পৃথক ১৪টি স্থায়ী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। গত তিন বছরে একটি কমিটিও গঠন করেননি মেয়র। তিনি পরিষদের সভা ডাকেন বাসায়। সেখানে মেয়রের অনুসারী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের রাখা হয়। তাদের সামনেই তিনি কাউন্সিলরদের অপমান করেন। কোনো ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে কাউন্সিলরদের জানানো হয় না। ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক থাকেন মেয়রের সঙ্গে। করোনাকলে দুস্থদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা কাউন্সিলরদের না দিয়ে ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। মেয়র তার অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়।