
রংপুরের ভাড়ারদহ বিলে পাতি সরালি পাখির ঝাঁক- সমকাল
প্রাণ-প্রকৃতির মেলা বসেছে রংপুরের ভাড়ারদহ বিলে। পাতি সরালি, জলময়ূর, চাপাখি, লরীয়তিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর পুরো বিল এলাকা। পাড়ে ধবল বক আর বিলের বুকে জলজ উদ্ভিদের ওপর তীক্ষষ্ট দৃষ্টিতে বসে থাকা মাছরাঙার দিনভর মাছ শিকার চলছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে আশ্বিনের তীব্র তাপদাহে একটু প্রশান্তির খোঁজে বিলের পাড়ে ছুটে আসছেন এলাকাবাসী আর প্রকৃতিপ্রেমীরা। শতাধিক দুর্লভ গাছে ভরা সবুজ প্রকৃতি, পাখ-পাখালির অবাধ বিচরণ মন কাড়ছে তাদের। অথচ ছয় মাস আগেও ভাড়ারদহ বিল ছিল সমতল ভূমি। শুস্ক মৌসুমে বিলের বুকে ধানগাছের সবুজের সমারোহ দেখা যেত। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধারের পর প্রাণ ফিরে পেল বিলটি। সেসঙ্গে পাখিদের অভয়ারণ্য, গাছের জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে বিল এলাকাটিকে। পার্শ্ববর্তী সরকারি খাস পাটোয়াকামড়ী বিল দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার ও পুনর্খননের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এলাকাবাসী ও বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, নদী বা কোনো বড় জলাশয়ের অতলস্পর্শ ও ঘূর্ণিময় অংশকে বলা হয় দহ। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার জামুবাড়ী মৌজার তেমনি একটি দহ যা 'ভাড়ারদহ' বিল নামে পরিচিত। বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত চিকলী ও গডডাংগী নদীর মিলনস্থল বা ঘূর্ণিময় অংশ ছিল এই ভাড়ারদহ বিল। চিকলী নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে এই অংশটি বিল আকারে তার অস্তিত্ব বজায় রাখে। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বিলটি ছিল দেশীয় মাছের ভান্ডার। বিলের যৌবনকালে স্থানীয়রা এ বিলে মাছ শিকার করতেন। বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কালের পরিক্রমায় যত্ন না থাকায় বিলটি মজে গিয়ে জলাভূমিতে পরিণত হয়। এরপর স্থানীয় দখলদাররা এক পর্যায়ে বিলটিকে কৃষিভূমিতে পরিণত করে। অর্ধশতাব্দী পর এলাকাবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিলটি পুনর্খননের উদ্যোগ নেয় বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নকশা দেখে বিলের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এরপর 'ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ (ইআইআর) প্রকল্পের আওতায় ১১ দশমিক ৫৯ একরের এ বিলটি চলতি বছরের ১ জানুয়ারি খনন শুরু করা হয়। খনন কাজে নেমে দখলদারদের তোপের মুখে পড়তে হয় বিএমডিএর কর্মকর্তাদের। কয়েক দফা দখলদারদের কারণে খনন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সব বাধা উপেক্ষা করে মার্চের শেষ সপ্তাহে পুনর্খনন কাজ শেষ হলে হারিয়ে যাওয়া ভাড়ারদহ বিল প্রাণ ফিরে পায়। এখন এ বিলে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঝাঁকবাঁধা পাতি সরালি, জলময়ূর, চাপাখি, লরীয়তি, বন ভারত, খঞ্জনা, চাতক, টুনটুনি, ফিঙ্গে, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, শালিক, দোয়েল, মাছরাঙাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলছে। ৬০ থেকে ১০০ ফুট চওড়া বিলের পাড়ে সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, কুরচি, ছাতিম, কদম, চিকরাশি, শ্বেত চন্দন, বকুল, গন্ধরাজ, মহুয়া, শিমুল (বার্মিজ), দেশি শিমুল, পলাশ, কাঞ্চন, হিজল, অশোক, পারুল, তমাল, চাঁপা, করম, বাজনা, গৌরিচৌরি, রাধাচূড়া, কাঠমল্লিকা, মাধবীলতা, টগর, হৈমন্তী, ডুমুর, ঢেউয়া, খড়কি জাম, কোরিয়ান জাম, কতবেল, আঞ্জির, জাফরান, হরীতকী, আমলকী, পানিয়াল, গাব, ননিফল, বুদ্ধ নারিকেল, বিলম্বি, গামারি, কাইজেলিয়া, ইপিল, বাবলা, বওলা, জিগনিসহ ১০৩ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে মাছ চাষের বড় সুযোগ।
স্থানীয় শিক্ষক হেলাল হোসেন শাহ বলেন, বদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে একটি দৃষ্টিনন্দন এলাকা হয়ে উঠেছে ভাড়ারদহ বিলটি। এ বিল উদ্ধার ও খনন আমাদের প্রাণের দাবি ছিল। এ ছাড়া আঞ্চলিক সড়ক
সংলগ্ন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থাকলেও তাদের কাছে প্রাকৃতিক পানির উৎস নেই। ভাড়ারদহ বিলের পাশে সরকারি খাস জমিতে পাটোয়াকামড়ী বিল রয়েছে। এই বিলটি উদ্ধারসহ খনন করা হলে জরুরি কাজে বিলের পানি ব্যবহার করা যাবে। সেসঙ্গে ভাড়ারদহে প্রাণ-প্রকৃতির যে মিলনমেলা বসেছে, সেটি আরও বিস্তৃতি লাভ করবে।
স্থানীয় কৃষক মজনু মিয়া বলেন, ভাড়ারদহে যে গাছগুলো লাগানো হয়েছে এর বেশিরভাগের নামই আমরা জানি না। এখানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এ বিলের পাড়ে বসার জায়গা করলে আমাদের জন্য ভালো হতো। এ ছাড়া এলাকাবাসীর দাবি, বিলে একটি ঘাট করে দেওয়া হোক। যেন বাচ্চারা সাঁতার শিখতে পারে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী একেএম ফজলুল হক বলেন, ভাড়ারদহ বিল সরকারি নথিতে বিল উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এটি জলাভূমি, কৃষি ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সীমানা নির্ধারণ করে ইআইআর প্রকল্পের আওতায় বিলটি খনন করা হয়। খননের শুরুতে দখলদাররা দু'বার খনন কাজে ব্যবহূত এক্সক্যাভেটর মেশিন বিল থেকে তুলে দেয়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় খনন কাজ শেষ করা হয়। খননের পর বিলে পানি থাকায় প্রচুর পাখি আসছে। বিলের প্রশস্ত পাড়ে ১০৩ প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। যারা গাছ নিয়ে গবেষণা করেন কিংবা শিক্ষার্থীদের গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এ বিলের গাছগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইআরআর প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান সমকালকে বলেন, ভাড়ারদহ বিল উদ্ধার ও পুনর্খননের মাধ্যমে তার পুরোনো অস্তিত্ব ফিরে পেয়েছে। এলাকাবাসী তাদের দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। বিলে হাঁস ও মাছ চাষের পাশাপাশি সঞ্চিত পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন বিল পুনর্খনন করা হবে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমে যাবে।
মন্তব্য করুন