নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া ও জিন্নাহপাড়া এলাকার প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দার যাতায়াতের একমাত্র সড়কটি মতিয়াখালী খালের (কংক্রিটের ড্রেন) পাশে। অতিবৃষ্টিতে বিশাল উন্মুক্ত এই খালের পানি উপচে সড়কে চলে আসে। এ সময় খাল ও সড়ক একাকার হয়ে যায়। আবার শুস্ক মৌসুমে খালের পানি নিচে নেমে গেলে এটি মনে হয় গর্তের মতো। এ পথে চলতে গিয়ে একটু ঝাঁকি খেলেই রিকশা-ইজিবাইকের যাত্রীরা আঁতকে ওঠেন, এই বুঝি কাত হয়ে খালে পড়ল গাড়ি। রাতে খালটির পাশ দিয়ে চলা আরও ভয়ংকর ব্যাপার।

শুধু মতিয়াখালী খালই নয়, বড় অনেক খালকে কংক্রিটের ড্রেনে রূপান্তর করা হয়েছে, এগুলোর বেশিরভাগই এখন উন্মুক্ত। এসব ড্রেনের পাশ দিয়ে দিনের পর দিন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে বাসিন্দারা।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ মারা গেছেন চারজন। একইভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে গত ছয় বছরে মারা গেছেন মোট আটজন। আহত হয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ ছাত্রীর মৃত্যুর পর সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা নিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হয়। ছাত্রীর প্রাণহানির পর ঘটনাস্থলে দেয়াল নির্মাণ করায় অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানান। তারা বলেন, নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ খালগুলোকে নিরাপদ করেনি। বারবার দুর্ঘটনার পরও চট্টগ্রাম নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ খাল-নালা নিরাপদ করার ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট দুই কর্তৃপক্ষের রেষারেষিও লক্ষ্য করা গেছে।

চট্টগ্রামের ভয়াবহ এমন পরিস্থিতি দেখে খুলনার মানুষও তাদের আশপাশে থাকা 'মরণফাঁদ' উন্মুক্ত খাল-নালা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় খুলনার উন্মুক্ত ড্রেনে পড়ে আহত হয়েছে শিশুসহ রিকশা ও সাইকেল চালকরা। কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। তবে খাল বা ড্রেনে পড়ে কেউ যে মারা যেতে পারে, চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দেখে সেটি তাদের মনে হয়েছে। তাই সব অরক্ষিত খাল-ড্রেনে দ্রুত নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে নগরবাসীকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন তারা। নইলে যে কোনো সময় চট্টগ্রামের মতো পরিণতি হবে বলে আশঙ্কা তাদের।

খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা যায়, নগরীতে এক হাজার ২০৫ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এর মধ্যে কতটুকু অংশ উন্মুক্ত তার পরিসংখ্যান দিতে পারেনি কেসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ক্ষেত্রখালী খাল, গোড়া খাল, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নবীনগর খাল, বাস্তুহারা খালের একাংশসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক কংক্রিটের ড্রেনই উন্মুক্ত।

সম্প্রতি টুটপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মহিরবাড়ি খালের ওপারে যাতায়াতের একমাত্র সড়কটি ড্রেনের পাশে। পুরো ড্রেন উন্মুক্ত। রাস্তা থেকে ড্রেনের উচ্চতা কোথাও এক ফুট, কোথাও কিছুটা বেশি। ড্রেনটি ১৫-২০ ফুট চওড়া। কয়েকটি স্থানে প্রশস্ততা সড়কের দ্বিগুণ। এ ছাড়া প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মতিয়াখালী খালের কোথাও নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখা যায়নি। কোনো সতর্কতা সাইনবোর্ডও নেই। পরিবেশ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এই ড্রেনে কেউ পড়ে গেলে ওঠার কোনো উপায় নেই।

বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাকারিয়া তুষার সমকালকে বলেন, ভারি বর্ষণ হলে ড্রেন ও সড়ক একাকার হয়ে যায়। তখন সড়কে নামতেই ভয় করে। রাতে বাড়ি ফিরতে আরও ভয় লাগে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ড্রেন করার সময় রেলিং না দেওয়াটা অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত ছিল। অবিলম্বে এসব ড্রেনে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। নইলে যে কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায় কেসিসিকে নিতে হবে।

কেসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফ হোসেন মিঠু বলেন, ড্রেনে কয়েকবার বাচ্চারা পড়ে গেছে। সবাই মিলে উঠিয়েছি। হাঁস-মুরগি প্রায় পড়ে যায়। তবে চট্টগ্রামের ঘটনার পর সবার হুঁশ ফিরেছে। অবিলম্বে ড্রেনের পাশে রেলিং দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।

কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ সমকালকে বলেন, নগরীর ভেতরের সব ড্রেনের ওপর স্লাব দেওয়া হচ্ছে। ভেতরের কোনো ড্রেন উন্মুক্ত থাকবে না। তবে বিশাল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের খালে স্লাব দেওয়া অনেক ব্যয়বহুল। এজন্য মতিয়াখালী ও ক্ষেত্রখালী খালের পাশে রেলিং দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে সাত কিলোমিটার রেলিংয়ের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী বছর কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।