রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর ভাঙন রোধে ডান পাশের সংরক্ষণ কাজের সিসি ব্লক ধসে পড়ছে। গত তিন মাসে অন্তত ১৪ দফা ভাঙনে এক হাজার মিটারেরও বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। ৩৭৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, শুরু থেকেই কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া নদী থেকে অবাধে ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙছে নদীপাড়। অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী।

জানা গেছে, শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ থেকে পাঁচশ মিটার দূরে ছিল পদ্মার অবস্থান। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাঙতে ভাঙতে পদ্মা নদী এখন বেড়িবাঁধের সন্নিকটে। কোথাও বেড়িবাঁধ ছুঁয়ে ফেলেছে নদী। ভাঙনে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাট-বাজারসহ বহু স্থাপনা বিলীন হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। এমন অবস্থার মধ্যেই রাজবাড়ী জেলা প্রশাসন কয়েক বছর ধরে বালুমহাল ইজারা দিয়ে চলেছে। চলতি বছর জেলার ছয়টি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়।

পদ্মা নদীর ভাঙনরোধে রাজবাড়ী শহর রক্ষা প্রকল্প (২য় পর্যায়) (১ম সংশোধিত) শীর্ষক ৩৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীর ডান তীর বাঁধাইয়ের কাজটি শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট। যেটি দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। মোট ছয়টি প্যাকেজের মাধ্যমে ভিন্ন ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজের দায়িত্ব পায়।

পাউবোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ছয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই কাজ শুরু করে ২০১৯ সালের ৮ জুলাই। কাজ শেষ দেখানো হয়েছে চলতি বছরের ৩১ মে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এখনও কাজ বুঝে নেয়নি।

প্রকল্পের কাজ চলার মধ্যেই গত ১৫ জুলাই শুরু হয় ভাঙন। এ পর্যন্ত ১৪ দফা ভাঙনে এক হাজার মিটারেরও বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। রেহাই পায়নি স্কুল ভবন, বসতঘর, ফসলি জমি, গাছপালা ইত্যাদি।

সদর উপজেলার চরসিলিমপুর থেকে সোনাকান্দর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙন রোধে প্রতিরক্ষা কাজের সিসি ব্লকগুলো ধসে নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে ফেলা হয়েছে বড় বড় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ।

স্থানীয় বাসিন্দা আল আমিন মোস্তফা জানান, যখন কাজটি করার কথা ছিল ঠিকাদার সে সময় করেনি। কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া নদী থেকে অবাধে এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন নদীভাঙনের অন্যতম কারণ।

পদ্মা নদীর ভাঙন এলাকা গত ৬ অক্টোবর পরিদর্শন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে লোহা দিয়ে বাঁধ তৈরি করলেও তা টিকবে না।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আহাদ বলেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করায় ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে। কর্তৃপক্ষের কাছে ডিজাইন পাঠানো হয়েছে। ডিজাইন অনুমোদন হওয়ার পর নতুন করে ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করাবো। কাজের অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন কী বলল না বলল সেটা নিয়ে ধরে বসে থাকলে চলবে না।

বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে বলেন, ডিসি অফিস বালুমহাল ইজারা দেয়। বালু উত্তোলন করে সাধারণত তীর থেকে এক বা দেড় কিলোমিটার দূরে। বালুবাহী বলগেট চলাচল এবং চাতালের কারণে নদীভাঙন হতে পারে এ বিষয়ে আমরা অনেক আগেই সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়েছি। জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে তুলেছি। রাতের আঁধারে কেউ বালু তুললে সেখানে আমাদের কিছু করণীয় নেই।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেডের ম্যানেজার গোলাম সারওয়ার জানান, খুলনা শিপইয়ার্ড থেকে সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে তারা কাজ করছেন। গোদারবাজার এলাকায় কিছু জায়গায় ভেঙেছে। তারা শিডিউল অনুযায়ী কাজ করছেন। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ছোটখাটো কোনো সমস্যা হলে তা তারা মেরামত করে দেবেন।

রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙছে প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর বালুমহাল ইজারা বাতিল করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। টেকনিক্যাল সার্ভে করে যদি রাজবাড়ীর জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে ইজারা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।

পরিবেশ ব্যক্তিত্ব গৌতম রায় বলেন, নদীর পেটে ড্রেজিং মেশিনের খাবলে নদীর কোথাও শত ফুট, কোথাও ৫০ ফুট আবার ক্ষত সৃষ্টি করছে। এতে বন্যার আগে পরে জলস্রোত এসে কোথাও স্বাভাবিক আবার কোথাও অস্বাভাবিক ধাক্কা দিলে ভাঙন সৃষ্টি হতে বাধ্য হচ্ছ। এভাবে উঁচু জমি, বসতবাড়ি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। এর খেসারত দিচ্ছে নিরীহ মানুষ।