চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় ছয় বছর ধরে ভোট হচ্ছে না। জাতীয় সংসদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন হলেও ভোট দিতে পারেনি এ জনপদের ছয় লাখ মানুষ। ভোটারের হিসাব করলে দুই লাখ ৭০ হাজার ৭৬০। নির্বাচন এলেও এখানে ভোটের জন্য মাইকিং হয় না। পোস্টার ছাপাতে হয় না। বিতরণ হয় না লিফলেটও। এখানকার কোনো নির্বাচনে থাকে না বিরোধী দল। থাকেন না সরকার দলীয় একাধিক প্রার্থী। প্রতিটি নির্বাচনের আগে এ উপজেলাতে হয় 'বৈঠক'। সেখানে যে প্রার্থীকে চূড়ান্ত করা হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'নির্বাচিত' হন তিনিই। এ 'প্রথার' বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করতে চান তাদের হয় ভোটের মাঠ ছাড়তে হয়, না হয় ছাড়তে হয় রাউজান।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। এর পর থেকে রাউজান হয়ে উঠতে থাকে বিনা ভোটের 'দারুণ মডেল'।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাউজানের একাধিক রাজনৈতিক নেতা বলেন, ফজলে করিম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হবার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তার হস্তক্ষেপে শুরু হয় বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক। পৌর মেয়র থেকে ইউপি সদস্য পর্যন্ত তার ইশারায় প্রার্থী হন। তার কথার বাইরে কেউ প্রার্থী হলে এলাকা ছাড়া হতে হয়, হামলার শিকার হতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দারা দেবাশীষ পালিতের কথা বলেন। তিনি ২০১৫ সালে রাউজান পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু পাঁচ বছর পৌর কার্যালয়ে যেতে পারেননি দেবাশীষ। মেয়াদের পুরোটা সময় চট্টগ্রাম শহরে থেকে মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাকে।
জেলা যুবলীগ নেতা দেবাশীষ পালিত জানান, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনের আগে তিনি দু-একদিন পৌর কার্যালয়ে যেতে পেরেছেন। এর পর আর তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। তিনি সমকালকে বলেন, 'কেন নির্বাচিত মেয়র হওয়ার পরও রাউজানে যেতে পারিনি তা সবাই জানেন। নতুন করে কিছু বলে বিপদে পড়তে চাই না।'
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১১টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এবারের ইউপি নির্বাচনেও চিত্র অভিন্ন। ১৪টি ইউনিয়নে ১৪ জন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ১২৬টি সাধারণ ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য প্রার্থীও হয়েছেন ১২৬ জন। ৪২টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিপরীতেও প্রার্থী হয়েছেন ৪২ জন। এবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'একটি উপজেলাতে ছয় বছর ধরে স্থানীয় সরকারের কোনো ভোট না হওয়া প্রহসন ছাড়া আর কিছু না। এটি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি তৈরি করছে অনাস্থা ও ঘৃণা।'
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে রাউজানে কেন ভোট দিতে পারে না জনগণ- এমন প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার রাতে রাউজানের এমপি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, 'স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী থাকছে না তা আমার জানা নেই। এটা ভালো বলতে পারবেন প্রার্থীরা।'
রাউজানের কোনো নির্বাচনেই কেন দেখা যায় না বিরোধী দলকে- এ প্রশ্নের জবাবে ফজলে করিম বলেন, 'বিরোধী দল তো দেশেই নেই। রাউজানে আসবে কোত্থেকে?'
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন করতে আপনার একক প্রভাব থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে এমপি বলেন, 'তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে কারা প্রার্থী হয়েছেন তাও জানি না আমি। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে ব্যস্ত আছি এখন।'
এবারও বিনা ভোটে ১৮২ জন :বিনা ভোটের রীতি নিয়ে রাউজানের এমপি কিছু জানেন না বলে দাবি করলেও সাধারণ মানুষ বলছেন, এমপির কথা ছাড়া পাতাও নড়ে না উত্তরের এই জনপদে। তৃতীয় ধাপে এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে নির্বাচন হচ্ছে। ১৮২টি পদে নির্বাচন হলেও কোনোটিতে এবারও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না রাউজানের ভোটাররা। সবক'টি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তৃতীয় ধাপে পাশের দুই উপজেলাতে নির্বাচন হলেও এমন নজির নেই। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৩টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়াও মোট ৪৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আর হাটহাজারী উপজেলার ১৩ ইউনিয়নে ২১ চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত ও সাধারণ সদস্যের ১২৫টি পদে ৪৬৪ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
যা বললেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা :জানতে চাইলে রাউজান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা অরুণ উদয় ত্রিপুরা বলেন, 'রাউজানের কোনো পদে একাধিক প্রার্থী নেই। ১৪টি ইউনিয়নে ১৪ জন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আর ১২৬টি সাধারণ ওয়ার্ডে মেম্বার প্রার্থীও রয়েছেন ১২৬ জন। ৪২টি সংরক্ষিত নারী আসনেও চিত্র অভিন্ন।'
কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। রাউজানের ১৪টি ইউনিয়ন ভোটকেন্দ্র ৮৪টি। নারী ভোটার এক লাখ ৩০ হাজার ৯৫১ জন এবং পুরুষ ভোটার এক লাখ ৩৯ হাজার ৮০৯ জন।
নেই ভোটের আমেজ :২৮ নভেম্বর ভোট হলেও নির্বাচনের কোনো আমেজই নেই রাউজানে। উরকির চর ইউনিয়নের বাসিন্দা হেফাজত করিম সমকালকে বলেন, 'রাউজানে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। গত ছয় বছর কোনো নির্বাচনেই ভোট দিইনি আমি। এখানে যে প্রার্থী হয় সেই জিতে।'
অভিন্ন মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া রাউজানের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম।
এর আগে রাউজানে পৌরসভা নির্বাচন হয় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। ভোট গ্রহণের আগেই মেয়র ও সাধারণ ওয়ার্ডের ১২ জন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৩ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। নির্বাচিতদের সবাই আওয়ামী দলীয় প্রার্থী। সেবারও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই ও বারইয়ারহাট পৌরসভাতে ভোট হয়েছে। সব পদে ছিলেন একাধিক প্রার্থী।
২০১৬ সালেও মাঠ ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার :২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১১টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এমন রীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাউজান উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জমির উদ্দিন বলেন, 'রাউজানের মুরব্বি হচ্ছেন এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। ওনার নির্দেশনা এবং পরামর্শে মডেল উপজেলায় রূপান্তরিত হচ্ছে রাউজান। কেউ ভোটে আসতে না চাইলে তো আর জোর করে আনা যাবে না।'
বিদ্রোহী হলেই নেওয়া হয় ব্যবস্থা :গত ফেব্রুয়ারিতে রাউজান পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দল থেকে মনোনয়ন পান পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু জাফর চৌধুরী। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। মনোনয়ন পাওয়ার পরও কেন নির্বাচন করেননি- এমন প্রশ্নের জবাবে আবু জাফর চৌধুরী বলেন, 'রাউজানে একজনের কথাই আইন। নানা চাপ উপেক্ষা করে আমি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়েছিলাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। কিন্তু তারা তা জমা নেননি। উপজেলাতে জমা দিতে বলেছেন। পরে আইনজীবীকে দিয়ে মনোনয়নপত্র পাঠিয়েছিলাম রাউজানে। কিন্তু তা জমা না দিয়ে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে এসেছেন তিনি।'
এ বিষয়ে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আবদুল ওহাব বলেন, 'রাউজানে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের প্রার্থী আসবে কোথা থেকে?'
এবার 'ভাগ্যবান' যারা :এবারের ইউপি নির্বাচনে রাউজান উপজেলায় মনোয়ন ফরম জমা দেওয়া প্রার্থীরা হলেন- রাউজান উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক উরকিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নৌকার প্রার্থী সৈয়দ আবদুল জব্বার সোহেল, রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক পশ্চিম গুজরার বর্তমান চেয়ারম্যান দলীয় প্রার্থী সাহাবুদ্দিন আরিফ, পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্বাস উদ্দিন আহম্মদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক পাহাড়তলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নৌকার প্রার্থী রোকন উদ্দিন, নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নোয়াপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল মিয়া, নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এম সরোয়ার্দী সিকদার, চিকদাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দলীয় প্রার্থী প্রিয়তোষ চৌধুরী, বাগোয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নৌকার প্রার্থী ভুপেশ বড়ূয়া, কদলপুর ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী নিজাম উদ্দিন আহম্মদ, হলদিয়া ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম, ডাবুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান চেয়ারম্যান দলীয় প্রার্থী আবদুর রহমান চৌধুরী লালু, বিনাজুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী রবীন্দ্র লাল চৌধুরী, রাউজান সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দলীয় প্রার্থী বিএম জসিম উদ্দিন হিরু, গহিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দলীয় প্রার্থী নুরুল আবছার।

বিষয় : ৬ বছর ভোট দিতে পারেনি

মন্তব্য করুন