- সারাদেশ
- 'বনের পাতা খেয়ে পোকা ঢেলে দেয় সোনার টাকা'
রাজশাহী সিল্ক
'বনের পাতা খেয়ে পোকা ঢেলে দেয় সোনার টাকা'

রাজশাহীতে রেশম কারখানায় শাড়িতে নকশা করছেন এক নারী কর্মী। সম্প্রতি তোলা ছবি- সমকাল
'বনের পাতা খেয়ে পোকা, ঢেলে দেয় সোনার টাকা'-রেশম নিয়ে প্রচলিত এ প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত বাংলার প্রায় সবাই। আমের পাশাপাশি এই রেশম বা সিল্ক্ক উৎপাদনে বিখ্যাত হওয়ার সুবাদে রাজশাহী সারা বিশ্বে সুপরিচিত 'রেশমনগর' বা 'সিল্ক্কসিটি' নামে। দেড় যুগ পর ২০১৮ সালে এই সিল্ক্কসিটির একমাত্র সরকারি রেশম কারখানাটি ফের চালু হয়। নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দেয় চাষি ও শ্রমিকদের মধ্যে। চলতি বছরের এপ্রিলের দিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার পর রাজশাহী সিল্ক্কের গুরুত্ব বেড়েছে আরও। সেই সঙ্গে বেড়েছে উদ্দীপনাও।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে রেশমকীট থেকে সুতা উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয় চীনে। অনেক চেষ্টা করেছিল তারা এর উৎপাদন কৌশল গোপন রাখার। কিন্তু দ্রুতই তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং রেশমকে ঘিরে বাংলায় আসতে শুরু করেন ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের বণিকরা। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষের দিকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বাংলার রেশম পোশাকের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইউরোপে এই রেশমবস্ত্র পরিচিত ছিল মসলিন নামে। নবম শতকের পর থেকে পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য ছিল রেশমবস্ত্র। তবে শিল্পবিপ্লবের ফলে রেশম বাজার হারাতে থাকে এবং ১৮৯৭ সালের মধ্যে অধিকাংশ রেশম কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
সোনালি অতীত: অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশেষত রেশমের সুতা তৈরির ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের একমাত্র বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে রাজশাহীর বোয়ালিয়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বোয়ালিয়ায় তখন বিস্তৃত এলাকাজুড়ে তুঁতের চাষ করা হতো। মূলত রেশম ব্যবসার কারণেই সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এ শহরে ওলন্দাজরা তাদের বাণিজ্যিক কুঠি তৈরি করে। এটিই ছিল এ শহরের সর্বপ্রথম বড় পাকা স্থাপনা। পরবর্তী সময়ে রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি এ অঞ্চলে বলতে গেলে একচেটিয়া রেশম ও নীলের কারবার পরিচালনা করে। এই কোম্পানি বৃহত্তর রাজশাহীসহ এর আশপাশের এলাকায় ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ১৫২টি রেশম ও নীলকুঠি স্থাপন করেছিল।
১৮৭০-এর দশকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজশাহীতে তখন রেশম শিল্পের বিকাশে কর্মসংস্থান ঘটেছিল প্রায় আড়াই লাখ মানুষের। কিন্তু ১৯০১ সালে এই সংখ্যা ৪১ হাজারে এবং ১৯২১ সালে মাত্র ৬০০ জনে নেমে আসে। এই শিল্পের এমন বিপর্যয় বাংলার তৎকালীন সরকারকেও উদ্বিগ্ন করে তোলে। ১৯০৮ সালে সরকার রেশমশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রথমবারের মতো দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়, যার অংশ হিসেবে রেশমপোকা চাষের জন্য একটি বিভাগ চালু করা হয়। শেষ পর্যন্ত এ
উদ্যোগ ব্যর্থ হয়; বাংলায় তুঁতগাছ চাষের এলাকা যেখানে ১৮৯৬ সালে ছিল ৫৪ হাজার হেক্টর, সেখানে ১৯৩৭ সালে তা নেমে আসে মাত্র চার হাজার হেক্টরে।
তবে ২০১৮ সালে রাজশাহীতে সরকারি রেশম কারখানাটি চালু হওয়ার পর আশার আলো জ্বলেছে নতুন করে। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে বর্তমানে দেশে রেশম পোকা চাষি রয়েছেন দুই হাজার জন। রেশম বা তুঁত গাছ চাষি রয়েছেন এক হাজার ৭০০ জন। বর্তমানে দেশে অন্তত ৬০০ টন রেশম সুতার চাহিদা রয়েছে। সেখানে সরকারি হিসাবে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৪১ টন রেশম সুতা।
রেশম রহস্য: রেশমগুটি দেখতে অনেকটা কবুতরের ডিমের মতো-যার ওপর হলুদ রেশম সুতা জড়ানো। রেশম পোকা তৈরি করতে হলে ২৬ থেকে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রেশম গুটি রেখে দিতে হয়। আট থেকে ১০ দিন পর গুটি ফুটো করে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি বা মথ। আলাদা গুটি থেকে নারী ও পুরুষ প্রজাপতি বেরিয়েই মিলিত হয় এবং পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা ওই অবস্থায় থাকে। মিলন শেষ হলে নারী প্রজাপতি ৪০০ থেকে ৫০০টি ডিম দেয়। এরপর নারী ও পুরুষ প্রজাপতি দুটোই মারা যায়। ডিম ফুটে পোকা বের হতে সময় লাগে আরও ১০ দিন। তারপর তারা টানা চার দিন তুঁতপাতা খেয়ে একদিন উপোষ করে। এদিন তাদের খোলস বদল হয়। এভাবে ২০ দিনে চারবার খোলস বদলানোর পর ৩০ দিন পেরুলে পোকার রং হালকা হলুদ হয়ে ওঠে। তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় চনরকীতে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রেশম পোকা তার মুখের লালা দিয়ে রেশম গুটি তৈরি করে এবং নিজে সেই গুটির ভেতর চলে যায়। সুতা তৈরি করতে হলে এই গুটিকে রোদে শুকিয়ে ভেতরের পোকাটিকে মারতে হয়। তা না হলে নতুন করে রেশম পোকা উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
রাজশাহী রেশম বোর্ডে নিয়োজিত রেশম পোকাচাষি শফিকুল ইসলাম টিটু বলেন, সুতা বের করতে হলে আধা ঘণ্টা গরম পানিতে গুটি সিদ্ধ করতে হয়। আট থেকে দশটি গুটির মাথা এক করে সুতা তৈরির মেশিনে দিলে একটি সুতা তৈরি হয়। একটি গুটি থেকে অন্তত ৫০০ মিটার সুতা তৈরি হয়। সুতা তৈরির কাজটি মূলত দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নারী শ্রমিকরা করে থাকেন।
রেশম বোর্ডের তাঁতি সানোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বছরে চার থেকে পাঁচটি রেশম মৌসুম থাকে গুটি উৎপাদনের জন্য। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে একটি রেশম মৌসুম ৩০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রধান প্রধান মৌসুম হচ্ছে-চৈত্র, জ্যৈষ্ঠ এবং অগ্রহায়ণ।
রেশম শাড়ির আভিজাত্য একটি দামি সুন্দর পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি। রেশম শাড়ি বিত্ত, সভ্যতা ও বাঙালি রমণীর ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যের প্রতীক। রেশম পোশাক গরদ, মটকা, বেনারসি, ঢাকার কাতান নামে পরিচিত। ইদানীং রেশমের মসলিন শাড়িও তৈরি হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও ঋতুচক্র, উৎসব, ঈদ, পূজা, সময় ও আবহাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে কারখানার স্বশিক্ষিত কর্মীরাই রেশম পোশাকের ডিজাইন করে থাকেন।
ডিজাইনার জালাল উদ্দীন, পারুল বেগম ও জয়নাল আবেদীন বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেশম কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে নানা ডিজাইনের রেশম পোশাক। এতে আকৃষ্ট হচ্ছে নতুন প্রজন্ম।
তাঁতির আয় ৩০০-৫০০ টাকা: রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের কারিগর রওশনা বেগম ও শাবানা বেগম জানান, রেশমগুটি থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়েই সিল্ক্কের কাপড় তৈরি হয়। কাপড় থেকে শাড়ি, দুই পিস, থান কাপড়, ওড়না, চাদর, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি হয়। রাজশাহী সিল্ক্ক কারখানায় এসব কাপড় বুনন করে নারী-পুরুষ তাঁতিরা মজুরি হিসেবে পান গজপ্রতি ৫০ টাকা। সারাদিনে একজন তাঁতি কাপড় বুনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সপুরা সিল্কের পরিচালক আশরাফ আলী বলেন, দেশে বর্তমানে রেশম সুতার চাহিদা ৬০০ টন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারিভাবে উৎপাদন হচ্ছে ৪১ টন। সুতা সংকটে রাজশাহীর বিসিকে অবস্থিত বেসরকারি ৭৬টি কারখানার মধ্যে ৭০টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চাষিরা ভুলতে বসেছেন রেশম চাষ।
রেশমশিল্প নিয়ে টানাটানি: রেশম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনে রাজশাহী রেশম কারখানাটি আধুনিক করে এবং এতে সুতা উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকার লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয় রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁ রেশম কারখানা দুটি। এতে রেশম চাষিরা তাদের উৎপাদিত রেশমগুটির বাজার হারাতে থাকেন। তুঁত বাগানগুলো আম বাগানে পরিণত হতে থাকে। ফলে রেশমশিল্পে অচলাবস্থা দেখা দেয়। পরে ২০১৩ সালে রেশম বোর্ড, রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং সিল্ক ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড।
বর্তমান অবস্থা: ২০১৮ সালে রাজশাহী রেশম কারখানাটি চালুর পর এর ৪২টি লুম মেরামত করা হয়। বর্তমানে এর ১৯টি লুমে ৪১ জন শ্রমিক ও তাঁতি কাপড় উৎপাদন করছেন। চালু হয়েছে বন্ধ শো-রুমও।
রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ম্যানেজার ও উৎপাদন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে রাজশাহী রেশম কারখানা মাসে এক টন সুতা উৎপাদন করছে। এতে প্রায় এক হাজার ২০০ গজ কাপড় তৈরি হচ্ছে। কারখানার শো-রুমে শাড়ি মিলছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকাতে। চাদর ও ওড়না মিলছে দুই হাজার টাকার মধ্যে। পাঞ্জাবি ও শার্টের পিস মিলছে ৮০০ টাকা গজ হিসেবে।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালে এক কেজি সুতার দাম ছিল এক হাজার টাকা। বর্তমানে সেই সুতার দাম কেজিপ্রতি সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে রেশম উন্নয়ন বোর্ড নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা কেজি দরে দেশি সুতা বিক্রি করছে বেসরকারি কারখানা মালিকদের কাছে।
রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও পরিকল্পনা) ড. এমএ মান্নান বলেন, রেশমের উন্নয়নে সরকারিভাবে দেশে ১৩৫ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প চালু রয়েছে। সুতার চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরই তুঁতগাছ লাগানো হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই রেশম সুতার উৎপাদন বাড়বে। তখন দেশি সুতাতেই শতভাগ রেশম তৈরি হবে।
মন্তব্য করুন