ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

হেরোইনের কারবারে বিপুল বৈভব, অতঃপর চেয়ারম্যান

বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও সমর্থন পেয়েছেন আ'লীগ নেতাদের

হেরোইনের কারবারে বিপুল বৈভব, অতঃপর চেয়ারম্যান

সোহেল রানা

সৌরভ হাবিব, রাজশাহী

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৩:৪৮

গোদাগাড়ীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ী ও নাশকতা মামলার আসামি সোহেল রানা গত সংসদ নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারের আতঙ্কে আত্মগোপনে ছিলেন। তবে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীককে হারিয়ে হয়েছেন চেয়ারম্যান। তার রয়েছে বিপুল অবৈধ সম্পদ, যা এসেছে মূলত হেরোইন ব্যবসা করে গত এক যুগে। তার টাকার কাছে বিক্রি হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই এবার তাকে ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ৩৪ বছর বয়সী সোহেলের বাবা মজিবুর রহমান বাসের ড্রাইভার ছিলেন। ১৫ বছর আগে সোহেল বাসের হেলপারি করতেন। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে তিনি এখন কোটি টাকার মালিক। তিনি পুলিশের হাতে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েক বছর আগে তার মামা মহিশালবাড়ীর গোলাম রাব্বানীকে এক কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করে বিজিবি। এ ছাড়া তার শ্যালক সবুজ এক কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হয়। এসব হেরোইনের মালিক ছিলেন সোহেল।
গত ১১ নভেম্বর গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তৎকালীন চেয়ারম্যান কলেজ শিক্ষক শহিদুল করিম শিবলী। এ নির্বাচনের আগে সোহেল রানার কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল না।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার টাকায় মাটিকাটায় আয়োজন করা হয় ইসলামী জলসার। সে জলসায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন প্রধান বক্তা। এ ঘটনায় সোহেলকেও আসামি করে নাশকতার মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় ৩৪ দিন হাজতবাস করেন তিনি। এর পর তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখান। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল অভিযোগ করেন, 'হেরোইন ব্যবসায়ী সোহেল রানার প্রচুর টাকা। তিনি টাকা দিয়ে দলীয় নেতাদের কিনে ফেলেন। গত ইউপি নির্বাচনে প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে শুনেছি।' তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সাংসদ ওমর ফারুকের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের চরম বিরোধ। তবে সোহেল রানাকে বিজয়ী করতে তারা একত্রে গোপনে কাজ করেছেন বলে শুনেছেন।
এ বিষয়ে সোহেলকে ফোন করলে তিনি বলেন, তারা দু'জন তাকে বিজয়ী করতে 'সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন'। দু'জনের মধ্যে বিরোধ থাকার পরও কেন সহযোগিতা করলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিরোধ আছে। তবে আমি চেষ্টা করেছি আমার পক্ষে রাখার। কিছু বিষয় তো থাকেই। তাই তারা আমার পক্ষে ছিলেন।' এ বিষয়ে একাধিকবার ফোন করলেও ওমর ফারুক ও আসাদুজ্জামান ফোন ধরেননি।
যত মামলা :গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সোহেল। এ ঘটনায় নাটোর সদর থানার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া ২০১৭ সালে পুলিশ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলা করেছিল। সে মামলায় তিনি জেলে ছিলেন। ২০১৩ সালে তার নামে মারামারির একটি মামলা হয়েছিল। স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগে গাইবান্ধায় হেরোইনসহ একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সোহেল রানা। পরে সে মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।
এ বিষয়ে সোহেল বলেন, তিনি জীবনে কখনোই মাদকসহ গ্রেপ্তার হননি। নাটোরে যে মামলা হয়েছিল, সে ঘটনায় তিনি আসামি ছিলেন না। পুলিশ ভুল করে তাকে আসামি করে। গাইবান্ধায় কখনোই গ্রেপ্তার হননি। তবে ২০১৭ সালে নাশকতা মামলায় জেলে থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি।
সম্পদের পাহাড় :সোহেল রাজশাহীর নিউমার্কেটে বিগবাজার ও শ্রাবণ ফ্যাশান নামে দুটি দোকানের মালিক। সংসদ সদস্য ওমর ফারুকের মালিকানাধীন বিলাসবহুল প্লাজায় ফ্ল্যাট কিনে সপরিবারে বাস করেন তিনি। এর দ্বিতীয় তলায় কাপড় ও কসমেটিকের দোকান এবং ফুড কর্নারেও একটি দোকান রয়েছে তার। তার ট্রাক রয়েছে চারটি। প্রাইভেটকার একটি। গোদাগাড়ীতে জমি কিনেছেন অন্তত ২০ বিঘা। এসব সম্পদ অর্জন বিষয়ে সোহেলকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আমার যত সম্পদ আছে তার সব খবর আয়কর বিভাগের জানা। আমি আয়কর দিই। আমার চার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আছে।'
তবে তার আয়কর নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, তিনি চলতি বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে আয়কর দিয়েছেন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। এ বছর তিনি আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। তার ঋণ দেখানো হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। ঋণসহ মোট নগদ টাকা দেখান এক কোটি ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তার নিজস্ব তহবিল ১৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা। নিজের স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে দেখান ৩৯ লাখ ১১ হাজার টাকা। তার ট্রাক, প্রাইভেটকার, বিগবাজারে দোকান, ওমর প্লাজার ফ্ল্যাট ও দোকান এবং গোদাগাড়ীর ২০ বিঘা জমির হিসাব আয়কর রিটার্নে দেখাননি তিনি।
এসব বিষয়ে ফোন করা হলে সোহেল এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার বিষয়ে আপনি যা খুশি লেখেন। তবে উল্টাপাল্টা কিছু লিখলে আপনার নামে মামলা করব।'

আরও পড়ুন

×