ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

রাষ্ট্রায়ত্ত কনডেনসেট রিফাইনারি সরকারি সিদ্ধান্তেই বেকার!

রাষ্ট্রায়ত্ত কনডেনসেট রিফাইনারি সরকারি সিদ্ধান্তেই বেকার!

তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৩:৪৯

দীর্ঘ ছয় মাস ধরে 'বেকার' হয়ে রয়েছে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ন্যাচারাল গ্যাস কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট। রহস্যজনক কারণে চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে কনডেনসেট ইআরএলে ন্যাচারাল কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। ইআরএলে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হলেও বেসরকারি দুটি রিফাইনারিতে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ইআরএলে ন্যাচারাল কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। এতে মানসম্মত তেল পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া ন্যাচারাল কনডেনসেট থেকে অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের মতো মূল্যবান জ্বালানি তেল পাওয়া যায়। ইআরএল প্লান্টে ন্যাচারাল কনডেনসেট পরিশোধনের ফলে উন্নতমানের জ্বালানি তেল মেলে। আবার পরিশোধন খাতে বাড়তি আয়ও আসে। এখন সেটাও বন্ধ রয়েছে।
ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ লোকমান সমকালকে বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের মূল কাজ হচ্ছে ক্রুড অয়েল (পরিশোধিত তেল) পরিশোধন করা। তবে একটা সময় আমরা বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে ন্যাচারাল কনডেনসেট পরিশোধনের মাধ্যমে ফিনিশ প্রোডাক্ট হিসেবে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে আসছিলাম। এ জন্য ইআরএলের একটি প্লান্টকে মডিফায়েড করে কনডেনসেট উৎপাদনযোগ্য করে তোলা হয়। প্রায় ছয় মাস ধরে কনডেনসেট না পাওয়ায় প্লান্টটি বন্ধ রয়েছে। কনডেনসেট পেতে আমরা সংশ্নিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি।
বিপিসি ও ইআরএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইআরএলে কনডেনসেট পরিশোধনের ফলে যে মানের তেল পাওয়া যায় বেসরকারি পরিশোধনাগারে সে মানের তেল পাওয়া যায় না। ইআরএলে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ক্রেতাদের উন্নতমানের তেল পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় আত্মঘাতী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ১৩টি ন্যাচারাল গ্যাস কনডেনসেট প্লান্ট রয়েছে। এর মধ্যে গুণগতমানের তেল উৎপাদন করতে না পারায় সরকার ১১টি প্লান্টে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। কেবল পেট্রোম্যাক্স ও সুপার পেট্রো কেমিক্যালসকে কনডেনসেট সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে একটি ছোটখাটো প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তে তাতেও অবশ্য অল্প পরিমাণে কনডেনসেট সরবরাহ করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শুরুতে আরএলকে মাসে ৫ হাজার টন (৪৩ হাজার ৬৭৬ ব্যারেল) করে কনডেনসেট বরাদ্দ ছিল। এ হিসেবে দৈনিক বরাদ্দ ছিল ১৪৫৫ ব্যারেল। পরে তা কমতে থাকে। বিপরীতে বেসরকারি প্লান্টে বরাদ্দ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মাসিক বরাদ্দ মাত্র ১৫ হাজার ব্যারেলে নেমে আসে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে তা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিপরীতে বেসরকারি দুটি প্লান্টে সক্ষমতার চেয়েও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারিকে গত ১০ মাসে দেওয়া হয় ৭০ হাজার ৬৬৭ টন। এ হিসাবে তারা দৈনিক বরাদ্দ পায় ২৫ হাজার ৫ ব্যারেল করে। অথচ ডিজাইন অনুযায়ী ওই রিফাইনারির প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টন! একইভাবে মেসার্স সুপার পেট্রো কেমিক্যালস একই সময়ে কনডেনসেট বরাদ্দ পায় এক লাখ ৩৫ হাজার ৬১৮ টন। এ হিসাবে তারা দৈনিক বরাদ্দ পায় ৪ হাজার ৫২০ ব্যারেল করে। বিপরীতে প্লান্টটির প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ ব্যারেল করে। এই চিত্র অনুযায়ী, দুটি বেসরকারি প্লান্টের মধ্যে পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট কনডেনসেটের ৩৪ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং সুপার পেট্রো কেমিক্যালসকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৬ শতাংশ করে। আর এই সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড বরাদ্দ পেয়েছে দৈনিক ৪ হাজার ২০০ ব্যারেল করে। এই রিফাইনারিটির দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ৭ হাজার ৭৫০ ব্যারেল।
৯০ দশকের মাঝামাঝি দেশের গ্যাস ফিল্ডগুলোতে কনডেনসেট সংরক্ষণের বিষয়টি বড় সমস্যায় পরিণত হয়। তখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ও স্টোরেজের ব্যবস্থা করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদনে সহায়তা করে। এ জন্য ইআরএল কনডেনসেট ইমপোর্ট লাইন স্থাপন, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক অ্যালোকেশন, স্পাইকিং লাইন স্থাপন করে কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তেল উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণ শুরু করে ইআরএল। এখন কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় বড় ধরনের ধাক্কা খেল এই পরিশোধনাগারটি। বছরে ৬০ হাজার টন কনডেনসেট পরিশোধন করতে পারে ইস্টার্ন রিফাইনারি। যদিও এ খাতে ইআরএল কর্তৃপক্ষেরও এক ধরনের অনাগ্রহও রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।
ইআরএলের প্রধান মোহাম্মদ লোকমান অবশ্য জানিয়েছেন, যে ধরনের কনডেনসেট থেকে বেশি পরিমাণে ডিজেল পাওয়া যায়, সরকার সেই ধরনের কনডেনসেট আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদেশি উৎস থেকে কনডেনসেট আনা হলে সেখান থেকে কনডেনসেট পেলে ইআরএল প্লান্টটি চালু করা যাবে।

আরও পড়ুন

×