চট্টগ্রামে মহানগরীর মাঝিরঘাট এলাকার পার্ব্বতী ফকিরপাড়ার পাশে গুলজার খাল খননে হেলে পড়ায় হেলে পড়েছে দুটি ভবন। ধর্মীয় উপাসনালয় ও অন্যান্য বাড়িতেও দেখা দিয়েছে ফাটল। ঝুঁকি বিবেচনায় বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় গুলজার খাল খনন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।খনন শুরু হওয়ার পর ভবনগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে। ভবন ও ঘরগুলোর বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে ভবনগুলো সিলগালা করে দিয়েছে সিডিএ। ভবনগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে দেয়ালও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

এলাকার পার্ব্বতী ফকিরপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, খাল খননের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে নারাজ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

ভবনগুলোর হেলে পড়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান সিডিএ’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা ভবনগুলোর ভার কমাতে মঙ্গলবার দুপুরে দেওয়াল অপসারণ শুরু করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্ষতিপূরণের দাবিতে সিডিএ কর্মকর্তাদের দ্বারস্ত হন তারা। 

কিন্তু সিডিএ কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন, ভবনগুলো অবৈধ। প্রকল্পের আওতায় এসব ভবনের ক্ষতিপূরণের কোনো সুযোগ নেই। 

নিরাশ হয়ে মাঝিরঘাটের স্ট্র্যান্ড রোড অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দুপুর সোয়া একটা থেকে সোয়া তিনটা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে তারা। এসময় সড়কের উভয় প্রান্তে তীব্র যানজট তৈরি হয়। আটকা পড়ে পণ্যবাহী বিভিন্ন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান। 

স্থানীয় যুবক নয়ন দাশ সমকালকে বলেন, ‘সরকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের প্রকল্পের কারণে যদি আমরা মাথা গোঁজার ঠাঁই হারাই, তাহলে এই উন্নয়ন দিয়ে কি করবো? আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। থাকার জায়গা চাই। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে ভবনগুলো হেলে পড়তো না।’ 

তিনতলা ভবনটির মালিক স্বপন দাশ সমকালকে বলেন, ‘সিডিএ’র অনুমোদন নিয়ে তিন থেকে চার বছর আগে পূর্বপুরুষের ভিটায় ভবনটি নির্মাণ করেছি। মাসহ তিন ভাইয়ের পরিবার নিয়ে এখানে আমরা থাকি। খাল খনন কাজ শুরুর আগে ভবনের বর্ধিতাংশ ভেঙ্গে দিয়েছে সিডিএ। খাল খনন করতে পাড় ঘেঁষে লোহার পাত পোতার সময় ভাইব্রেশনে ভবনগুলোতে ফাটল দেখা দেয়া শুরু করে। বিষয়টি তাদের জানালেও তারা কর্ণপাত করেনি। সোমবার খাল খননের কাজ শুরু হলে ফাটল বড় হয়ে ভবন খালের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন পরিবার নিয়ে আমরা কোথায় যাবো?’

পাশের আরেকটি ভবনের মালিক রাখাল দাশ সমকালকে বলেন, ‘লোহারপাতগুলো পোতার সময় ফাটল দেখা দেয়ায় আমাদের তিনতলা ভবনটি ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। সিডিএ কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। সেই জায়গায় এখন একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেছি। সেটিতেও ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা এখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাবো বুঝতেছি না।’ হেলে পড়া দুইতলা ভবনের মালিক আরতি দাশ সমকালকে বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছি। আজকে (মঙ্গলবার) কোথায় যাবো জানি না।’

অবরোধ চলাকালে ঘটনাস্থলে আসেন সদরঘাট থানা আওয়ামী লীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন। তিনি সিডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের বৈঠক করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। প্রকল্পের আওতায় গুলজার খালে সিল্টট্র্যাপ নির্মাণের কাজ চলছে। খালের পাড় ধস ঠেকাতে লোহার পাত পোতা হয়েছে। স্কেভেটর দিয়ে খননের সময়ে লোহারপাত বেঁকে গিয়ে ভবনের ভিতের মাটি খালের ধসে পড়ছে। এতে তিনতলা একটি, দুইতলা একটি ও একটি একতলা মন্দির খালের দিকে কাত হয়ে পড়েছে। মাটিতে দেখা দেয়া ফাটল ক্রমে বাড়ছে। 

সিডিএ কর্মকর্তাদের দাবি, নকশা ছাড়াই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। খালের পাড়ের ভবন নির্মাণ করতে হলে যে ভিত দিতে তা দেওয়া হয়নি। এ কারণে ভবনগুলো হেলে পড়ছে। 

স্থানীয়রা দাবি করছেন, খাল খননের সময় ভবনের ভিতের মাটি ধস ঠেকাতে যে ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা তারা নেয়নি।

সিডিএ’র অথরাইজড অফিসার মো. হাসান সমকালকে বলেন, ‘ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ভার কমাতে ভবনগুলোর দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ভবনগুলো সিলগালা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হবে।’

সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, ‘ভবনগুলো অবৈধ। তারা সিডিএ’র নকশা অনুমোদন নেয়নি। ভবনগুলোর ভিতও খুব নড়বড়ে। খাল পাড়ে ভবন নির্মাণ করতে যে ধরণের মাটি ভরাট করে (কম্পেকশন) ভিত দিতে হয় তারা সেটা দেয়নি। সিডিএ নকশা অনুমোদনের সময় খাল পাড় থেকে ১২ ফুট দূরুত্বে ভবন নির্মাণের শর্ত দিয়ে থাকে। এখানে ভবনগুলো খালের গা ঘেঁষে তোলা হয়েছে।’

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী সমকালকে বলেন, ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খাল খননের কাজ করা হচ্ছে। মাটির প্রায় ৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত লোহারপাত পোতা হয়েছে। ভবন অনুযায়ী ভিত তৈরি না করায় ভবনগুলো হেলে পড়ছে।’