নিত্যপণ্যের মতো হুহু করে বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। রড, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বালু, বিটুমিনসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে উন্নয়ন প্রকল্প ও আবাসন খাতে। এর ফলে নির্মাণকাজের ভরা মৌসুমেও এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় উন্নয়ন প্রকল্পের রি-শিডিউল চান ঠিকাদাররা। এ জন্য ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে তারা আলটিমেটাম দিয়েছেন। অন্যথায় এরপর থেকে চট্টগ্রামে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।

নির্মাণসামগ্রীর পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৮ থেকে ৯ মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণকাজ কমে গেছে। এর ফলে নির্মাণসামগ্রী বেচাকেনাও কমেছে।

চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে ৬০ গ্রেডের প্রতি টন লোহার রড ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকা করে বিক্রি হয়েছে। অথচ সেই রডের দাম বেড়ে এখন ৮০ হাজার টাকার ওপরে। ব্র্যান্ড ভেদে মিলগেটে প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৭৮ হাজার থেকে ৭৯ হাজার টাকা। আর খচুরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮১ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৮ থেকে ৯ মাসে রডের দাম বেড়েছে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রডের পাশাপাশি বেড়েছে সিমেন্টের দামও। মার্চ-এপ্রিলের দিকে মিলগেটে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি বস্তায় গড়ে ৫ টাকা লাভে বিক্রি করা হয়। এই সিমেন্ট এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪১০ টাকায়। চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম রড-সিমেন্টের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স নজরুল ট্রেডিং ও তিন কিলোমিটারের ব্যবধানে বহদ্দারহাট মোড়ে এসএ এন্টারপ্রাইজে খোঁজ নিয়ে কয়েক মাসের ব্যবধানে রড-সিমেন্টের দাম বৃদ্ধির এই চিত্র পাওয়া যায়।

মেসার্স নজরুল ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম ও নসরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, রড-সিমেন্টের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অনেকে নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছেন। অনেকে আবার কাজ শুরু করছেন না। অন্যান্য বছর এমন সময়ে যে বেচাকেনা হতো, এখন তার অর্ধেকও হচ্ছে না। এসএ ট্রেডিংয়ের মালিক এসএ আইয়ুব জানান, এমনিতেই নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। তারপরও আগে বড় ঠিকাদাররা মিল থেকে সরাসরি রড-সিমেন্ট ক্রয় করতেন। এখন ছোট ও মাঝারি মানের ঠিকাদাররাও মিল থেকে সরাসরি রড-সিমেন্ট কিনছেন। ফলে সাধারণ খুচরা বাজারে বেচাকেনা কমে গেছে। তবে সংশ্নিষ্ট মিল মালিকরা বলছেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে রড ও সিমেন্টের দাম।

চলতি বছরের শুরুর দিকে ইটভাটাগুলোতে প্রতি হাজার ইট বেচাকেনা হয়েছে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকায়। এখন সেই ইট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৯ হাজারে। একইভাবে বেড়েছে পাথরের দামও। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ায় তৈরি ইটের বেশ কদর রয়েছে। চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকার বিবিএম ব্রিকফিল্ডের মালিক মো. আলী সমকালকে বলেন, কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। ৮ থেকে ৯ মাস আগে প্রতি টন কয়লা ৮-৯ হাজার টাকায় বেচাকেনা হলেও এখন সেই কয়লা ক্রয় করতে হচ্ছে ১৮ থেকে ১৯ হাজার টাকায়। ফলে ইট তৈরিতে খরচ বেড়ে গেছে।

একই সময়ে আমদানিকৃত প্রতি টন পাথর তিন হাজার ৪০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন সেই পাথর বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকায়। চট্টগ্রামের পাথর সাপ্লাইয়ার ব্যবসায়ী মো. জাফর বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা করলে দেশীয় বাজারেও পাথরের দাম ওঠানামা করে। তবে কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রতি টন পাথরে গড়ে ৫০০ টাকা করে দাম বেড়েছে।

দাম বেড়েছে বিটুমিনেরও। রাস্তাঘাট পাকাকরণের অন্যতম এই উপাদান বিটুমিন। ১৫০ কেজির প্রতি ড্রাম বিটুমিন আগে বিক্রি হতো ছয় হাজার ৩০০ থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকায়। এখন সেই বিটুমিন মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায়। নির্মাণকাজে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার থেকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির উৎপাদিত বিটুমিন সরবরাহ ভালো থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তারপরও ড্রাম সংকট থাকায় সরবরাহ আরও কমে গেছে। ফলে বিদেশ থেকে বিটুমিন আমদানি বেড়েছে। বেড়েছে দামও। বালুর দাম খুব একটা না বাড়লেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন খরচ। প্রতি ফুট বালু মানভেদে ১৪ থেকে ১৮ টাকা বিক্রি হলেও এখন অতিরিক্ত পরিবহন খরচ ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে ১৭ থেকে ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় বেকায়দায় পড়েছেন ঠিকাদাররা। এমনকি একজোট হয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। শুধু চট্টগ্রামেই এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ চলছে। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে তার প্রভাব পড়েছে এসব উন্নয়ন প্রকল্পে। তাই এসব কাজ রি-শিডিউল করা না হলে কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকার কথা ভাবছেন তারা।

চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, রড, সিমেন্ট ও ইট-বালুর দাম তো বেড়েছেই, ইলেকট্রিক, হার্ডওয়্যার, স্যানিটারি সামগ্রীর দামও অনেক বেড়েছে। ৮-৯ মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। যেভাবে এসব সামগ্রীর দাম বেড়েছে, তাতে ঠিকাদারদের পক্ষে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, লোকসানে পড়তে হচ্ছে। তাই আমরা প্রকল্পের কাজে রি-শিডিউল চাই। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে এটা করা না হলে আমরা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।