বীজ হিসেবে খাবার আলু গছিয়ে কৃষকের সর্বনাশ

ছবি: সমকাল
জয়পুরহাট ও আক্কেলপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:৫৬
উত্তরাঞ্চলে আলু উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে জয়পুরহাট। এ জেলার আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী ইউনিয়নের গুডুম্বা এবং গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সোনায়মাগুড়া ও কাশিরা গ্রামের ৪১ কৃষক ১০০ বিঘা জমিতে ডায়মন্ড জাতের বীজ আলু রোপণ করেছেন। এসব বীজ তারা কিনেছিলেন নীলসাগর সিডস অ্যান্ড টিস্যু কালচার লিমিটেডের ডিলারের কাছ থেকে। কিন্তু রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও গতকাল বুধবার পর্যন্ত গাছ ওঠেনি বলে জানিয়েছেন কৃষক। মাটি সরিয়ে তারা দেখেছেন, রোপণ করা আলু পচে গেছে।
ক্ষেতলাল উপজেলার কলিঙ্গা গ্রামের ১০-১২ জন কৃষক আনুমানিক ৫০ বিঘা জমিতে ব্র্যাক সিডসের বীজ আলু রোপণ করেন। একই উপজেলার ফকিরপাড়া গ্রামে সাত-আট কৃষক ৩৫ বিঘা জমিতে ব্র্যাক ও নীলসাগর সিডসের বীজ আলু রোপণ করেন। তারাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কৃষকের অভিযোগ, চলতি রোপণ মৌসুমের শুরুতেই বীজ আলু নিয়ে জালিয়াতি করছেন সংশ্লিষ্টরা। দাম বেশি হওয়ায় বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফলে রোপণের সময় সংকট দেখে খাবার আলুই বীজ আলু হিসেবে কৃষকের কাছে গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জয়পুরহাটে ৩৮ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২২৫ হেক্টর জমিতে বেশি। কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার অধিকাংশ জমিতে সপ্তাহখানেক আগেই আলু রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এ তিন উপজেলার ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ বিঘা জমিতে রোপণ করা বীজ আলু পচে গেছে।
জেলার কৃষকরা যে আলু চাষ করেন এর মধ্যে কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, লাল পাকড়ি, স্ট্রিক ও ১২-১৩ নামের জাত উল্লেখযোগ্য। বেশির ভাগ কৃষকই বীজ আলু কিনেছেন ব্র্যাক সিডস ও নীলসাগর সিডস অ্যান্ড টিস্যু কালচার লিমিটেডের ডিলারের কাছ থেকে। তারা জানিয়েছেন, ১৫ থেকে ২০ দিন আগে যেসব আলু রোপণ করেছেন বুধবার পর্যন্ত বেশির ভাগের চারা ওঠেনি।
কৃষকরা জানান, আগের মৌসুমে এক বিঘা জমিতে আলু রোপণ বাবদ তাদের খরচ হয়েছিল ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। এবার তা বেড়ে ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। খাবার আলু কোম্পানির ট্যাগ লাগিয়ে সিল দেওয়া বস্তায় ভরে বীজ আলু হিসেবে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা এ জন্য আক্কেলপুরের নীলসাগর কোম্পানির ডিলার কাজী মেহেদী হাসান ডানো ও নুরুল ইসলাম, ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলী বাজারের ব্র্যাকের ডিলার শারফুল ইসলাম ও ইটাখোলা বাজারের ব্র্যাকের ডিলার উসমানুজ্জামান ও নীলসাগরের ডিলার মিজানুর রহমানসহ অন্যদের দায়ী করেছেন।
কালাইয়ের করিমপুর গ্রামের মাহবুব হোসেন পাঁচ বিঘা জমিতে কার্ডিনাল জাতের আলু রোপণ করেন। এ জন্য বীজ আলু কেনেন নীলসাগর কোম্পানির ইটাখোলা বাজারের ডিলার মিজানুরের কাছ থেকে। মাহবুব বলেন, ‘রোপণের ১৫ দিন পার হয়ে গেছে। আজও গাছ ওঠেনি। ডিলারকে বলতে গেলে উল্টো আমাকেই দোকান থেকে বকা দিয়ে বের করে দিয়েছে।’ এমন হলে কৃষকরা কোথায় যাবে– এ প্রশ্ন ছুড়ে দেন মাহবুব। করিমপুর ও কালাই পৌর শহরের পূর্বপাড়া মহল্লায় বেশ কয়েকজন কৃষক ব্র্যাকের বীজ আলু রোপণ করে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
আক্কেলপুরের গুডুম্বা গ্রামের কৃষক মালেক হোসেন বলেন, কয়েকদিন ঘুরে বেশি দামে ডায়মন্ড জাতের বীজ আলু কিনেছিলেন আক্কেলপুরের নীলসাগর কোম্পানির ডিলার কাজী মেহেদী হাসান ডানোর কাছ থেকে। ১২ বস্তা বীজ আলু কেনার সময়ই আলুতে কালো দাগ ছিল। এ বিষয়ে ডিলারকে বলেও সাড়া পাননি। তিনি এভাবেই রোপণ করতে বলেন। এখন মালেক দেখছেন, জমিতে গাছ উঠছে না। মাটি সরিয়ে দেখেন সব আলু পচে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমারই এ অবস্থা নয়, অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ জনের একই অবস্থা।’ এ বিষয়ে তারা ইউএনও ও কৃষি কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন।
ডিলার কাজী মেহেদী হাসান ডানোর ভাষ্য, ‘কৃষকের সমস্যা জানার পর আমি কোম্পানিকে জানিয়েছি। তাদের কর্মকর্তারা এলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তাঁর দাবি, আগে কোনো বছর এমন ঘটনা ঘটেনি। এবারই প্রথম।
ক্ষেতলালের কলিঙ্গা গ্রামের ইনসান ফকির ১২ বিঘা জমির জন্য ডায়মন্ড বীজ কেনেন ইটাখোলা বাজারের ব্র্যাকের ডিলার উসমানুজ্জামানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে দু-একটি গাছ উঠেছে। বাকি আলু পচে গেছে। কী যে করব, ভেবে পাচ্ছি না।’ ডিলার উসমানুজ্জামান বলেন, ‘ব্র্যাক সিডসের এমন রেকর্ড নেই। কেন এ বছর এমন হলো তা বুঝতে পারছি না।’ বিষয়টি ব্র্যাকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপককে জানিয়েছেন তিনি।
কয়েক বছরে ব্র্যাক সিডসের এমন রেকর্ড নেই বলে দাবি ব্র্যাকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (বীজ) জহুরুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, রোপণের পর সঠিক সময়ে সেচ না দেওয়াসহ অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে এমন হতে পারে।’ পরিদর্শনে গিয়ে এর রহস্য উন্মোচন করতে চান তিনি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাহেলা পারভিন জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৫৬ জন কৃষকের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। এগুলোর তদন্ত চলছে।