বাবাকে হত্যার পর ছেলেকে হুমকি
‘তোর বাপের মতন তোরেও খামু’

তৌহিদুল ইসলাম
এম সেকান্দর হোসাইন, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৫১
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রোববার সন্ধ্যায় হত্যার শিকার হন বিএনপি নেতা নুর মোস্তফা ওরফে বজল। এ সময় দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে তাঁর ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে বজলের মামাতো ভাই তৌহিদুল ইসলামের নাম জানিয়েছে। এমনকি বজলকে হত্যার আধা ঘণ্টা পর তাঁর ছেলে তাউসিফ ফেরদৌস তারেককেও মোবাইল ফোনে হুমকি দেয় তৌহিদ।
একই রাতে উপজেলায় আরও দু’জন হত্যার শিকার হন। রাত ৯টার দিকে জঙ্গল সলিমপুরে হামলার শিকার হয় মোহাম্মদ ইমরান (১৫) নামে এক কিশোর। রাত ২টার দিকে হাসপাতালে মারা যায় সে।
এ ছাড়া ১১টার দিকে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাইছড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে ফেলে যায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. আলমগীর হোসেন সওদাগরকে (৩৫)। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উপজেলায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
নুর মোস্তফা ওরফে বজল (৫০) উপজেলার বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের পশ্চিম লালানগরের বাসিন্দা। গ্রাম্য সর্দার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তাঁর। তিনি ওই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মুজিবুল হকের ছেলে। একই ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি পদেও ছিলেন বজল। তাঁর ছোট ভাই ইসমাইল হোসেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি।
তৌহিদুল ইসলাম (৩৩) একই এলাকার আবুল খায়েরের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি, হত্যা, লুটপাটসহ ১৮টির বেশি মামলা রয়েছে।
স্থানীয়দের বরাতে পুলিশ জানায়, নিহত নুর মোস্তফার আপন মামাতো ভাই তৌহিদুল ইসলাম। সম্পত্তি নিয়ে দু’জনের বিরোধ ছিল। এ ছাড়া ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের জন্য তৌহিদুলের বিরুদ্ধে গ্রাম্য সালিশ হয়। সেখানে তাকে গ্রামে ঢুকতে মানা করা হয়। এসব কারণে নুর মোস্তফার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল তৌহিদুল।
রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মৌলভীপাড়া এলাকায় একা পেয়ে নুর মোস্তফার ওপর হামলা করে তৌহিদুলের নেতৃত্বে ১৫-২০ দুর্বৃত্ত। তারা কুপিয়ে মোস্তফার ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুকে গুলি করে। এ সময় এলাকাবাসী তাদের ঘিরে ফেললে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের নিয়ে পালিয়ে যায় তৌহিদুল।
গুরুতর অবস্থায় মোস্তফাকে সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তবে চিকিৎসকরা দেখে বলেন, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুর উদ্দিন রাশেদ বলেন, শরীর থেকে তাঁর ডান হাত বিচ্ছিন্ন ছিল। পাশাপাশি বুকে গুলির চিহ্ন দেখেছেন।
ঘটনার আধাঘণ্টা পর মোবাইল ফোনে তৌহিদুল ফোনে হত্যার হুমকি দেয় বলে জানান মোস্তফার ছেলে তাউসিফ ফেরদৌস তারেক। তাঁকে কল দিয়ে তৌহিদুল বলে, ‘এবার তোর পালা। তোর বাপের মতন তোরেও খামু।’
তারেকের ভাষ্য, তাঁর বাবা রাজনৈতিকভাবে বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘হত্যাকারী তৌহিদুল আমাদের আত্মীয়। সে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নানা অপকর্মে জড়িত। বাবা এর প্রতিবাদ করতেন।’ এ কারণেই তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
কে এই তৌহিদুল
এলাকাবাসী জানান, শৈশব থেকেই বখাটেপনা শুরু তৌহিদুলের। অল্প বয়সেই নারী উত্ত্যক্তকরণ ও চুরি-ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে। গত ১০ বছরে একাধিক ব্যক্তির ওপর হামলায় জড়িত সে। প্রায়ই এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। কয়েক বছর আগে সৈয়দপুর ইউনিয়নের শেখেরহাট এলাকায় তৌহিদুলের নেতৃত্বে নুরুল হুদা নামে এক ব্যক্তির ওপর হামলা হয়। এ সময় নুরুলের ডান পা কেটে ফেলে তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময় যুবদলের রাজনীতি করত তৌহিদুল। ক্ষমতার পালাবদলের পর তার রাজনৈতিক পরিচয়ও বদলে যায়। এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী হয়ে ওঠে। পরিচয় দেয় যুবলীগের নেতা হিসেবে। তবে ওই সংগঠনের দায়িত্বশীল কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৌহিদুল যুবলীগের কোনো ইউনিটের কোনো পদে নেই। কিছুদিন আগেই সে চট্টগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের অনুসারী ছিল। আসন্ন নির্বাচনে দলের প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছে।
তবে এস এম আল মামুন বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা কখনও রাজনৈতিক কর্মী হতে পারে না। পারিবারিক ও পূর্বশত্রুতার জেরে নুর মোস্তফা খুন হয়েছেন বলে শুনেছি। হত্যাকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ কোনো সন্ত্রাসী-ডাকাতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, অবস্থাদৃষ্টে তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক কারণে এ হত্যাকাণ্ড হয়নি। হত্যাকারী তৌহিদুল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে ডাকাতি-হত্যাসহ ১৮টির বেশি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে।
বিএনপির প্রতিবাদ
বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবু জাফর ভূঁইয়া জানিয়েছেন, নিহত নুর মোস্তফা বজল ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন। তারা এ হত্যার নিন্দা জানান।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেনের বড় ভাই নুর মুস্তাফা বজল হত্যায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা জড়িত।
যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন বিবৃতিতে এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেন, হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তারা।
আরও দুই খুন
ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে সমবয়সীদের হাতে প্রাণ গেছে মোহাম্মদ ইমরানের (১৫)। সে সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর এলাকার মো. সবুজের ছেলে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে ওই এলাকার ২ ও ৪ নম্বর সমাজের শিশু-কিশোরদের বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে রোববার সন্ধ্যায় তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি ও পরে মারামারি হয়। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি মীমাংসা করেন।
রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার সময় ইমরানের ওপর হামলা করে কয়েকজন। আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত ২টার দিকে সে মারা যায় বলে জানান ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মাসুদ রানা। এ ঘটনায় তার বাবা মো. সবুজ বাদী হয়ে সোমবার দুপুরে মামলা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আটক তিন কিশোরকে এতে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
রাত ১১টার দিকে উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাইছড়িতে হামলার শিকার হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. আলমগীর হোসেন সওদাগর (৩৫)। বাড়ির পাশের একটি মুরগির খামারের কাছে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে। স্থানীয় লোকজন ভাটিয়ারী বিএসবিআরএ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক আলমগীরকে মৃত ঘোষণা করে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বছর তিনেক আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন আলমগীর। মাস তিনেক আগে বিয়ে করেন। তাঁর দোকান দক্ষিণ সোনাইছড়ির চৌধুরীঘাটা এলাকায়। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
একই এলাকার আবুল হাসেম মাস্টারবাড়ির আফাজ উল্লাহর ছেলে আলমগীর সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। তাঁর ছোট ভাই মো. জাহাঙ্গীর আলম একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক।