ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

পাহাড়ি নদীগুলো শুকিয়ে মরা খাল

পাহাড়ি নদীগুলো শুকিয়ে মরা খাল

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার ফুলবাড়ি এলাকায় গণেশ্বরী নদীর বুকে বালু চর সমকাল

নেত্রকোনা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩৯

নেত্রকোনার পাহাড়ি নদী গণেশ্বরী, সোমেশ্বরী, উদ্ধাখালীর বুকে বালুর চর জেগে উঠেছে। নদী নয়, যেন মরা খালে পরিণত হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা নদীগুলো। মানুষ হেঁটে পার হচ্ছেন এসব নদী।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, নেত্রকোনার গণেশ্বরী, উদ্ধাখালী ও সোমেশ্বরীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। নদীগুলোর প্রশস্ততা বিভিন্ন স্থানে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্ষাকালে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ দেখা যায়। বছরের বাকি সময় পানিপ্রবাহ থাকে না। আর শুষ্ক মৌসুমে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে যায় এসব নদী। তখন নদীর বুকে কয়লা ও পাথর সংগ্রহ করেন দরিদ্র লোকজন।
এলাকাবাসী জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে বালু এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় সীমান্তবর্তী নদীগুলো দিয়ে চলত বড় বড় নৌকা ও লঞ্চ। নদীতে পাওয়া যেত মহাশোল ও বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী। কালের পরিবর্তনে এখন আর চলে না বড় কোনো নৌযান। নদীর বিভিন্ন স্থান দখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দেখা যায় না মাছ ও জলজ প্রাণী। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না।
গণেশ্বরী ও উদ্ধাখালী নদীর তীরবর্তী ফুলবাড়ী, রগুনাথপুর, ছত্রংপুর, লেঙ্গুরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে পানিপ্রবাহ নেই। নদীর বুকে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠেছে। বালুচর থেকে কয়লা ও পাথর সংগ্রহ করছেন স্থানীয় লোকজন। বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে কয়লা ও পাথর।

কথা হয় লেঙ্গুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রত্যয় জাম্বিল, সাজিদা আক্তার খাতুনসহ কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে।
প্রত্যয় জাম্বিল জানান, ৯০-এর দশকেও গণেশ্বরী নদী দিয়ে চলত বড় বড় পালতোলা নৌকা। নৌকায় করে মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। নদীতে এখন আর নৌকা চলে না। নদী ভরাট হয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা বালু ও পাথরে নদীর তলদেশ ভরে গেছে।
কলমাকান্দা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সুকুমার চন্দ্র বণিক বলেন, পাহাড়ি নদীগুলোতে সারাবছর পানি থাকত। নদীতে থাকত মাছ-জলজ প্রাণী। এখন আর নেই সেই সবের কিছুই। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
লেঙ্গুরা উত্তর বাজারের ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম জানান, নদীটি খনন করা প্রয়োজন। তা হলে নাব্য ফিরে পেত। এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর হতো। একই বাজারের ব্যবসায়ী বিচিত্র সাহা বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় নৌকা আসত। নদীতে বালু পড়ে এখন আর পানি নেই। নদীর বুকে চর জেগে ওঠায় মানুষ হেঁটে পারাপার হয়।’

দুর্গাপুরের সংস্কৃতিকর্মী তোবারক হোসেন খোকনের ভাষ্য, বর্ষাকালে সোমেশ্বরী নদী খুব সুন্দর দেখায়। পর্যটনশিল্পের জন্য সোমেশ্বরী নান্দনিক স্থান। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় এ নদীতে পানি থাকে না। নদীটি খনন করা প্রয়োজন।
লেঙ্গুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার দাবি, এলাকার নদীগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষ করে গণেশ্বরী নদী। ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টি হলেই নদী পানিতে ভরে যায়। সামান্য বৃষ্টিতেই দুই তীর উপচে তীরবর্তী গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। রগুনাথপুর গ্রামের তাজউদ্দিন ইসলাম বলেন, ‘গণেশ্বরী নদীর অনেকটা জায়গা ভারতের মধ্যে আছে। আমরা গরিব মানুষ, নদী থেকে কয়লা-পাথর তুলে বিক্রি করি। আমরারে কেউ কিছু বলে না। সারাদিন যা পাই, তা বিক্রি করে আমার সংসার চলে।’
বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমানের ভাষ্য, নেত্রকোনার খরস্রোতা নদনদী হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে গণেশ্বরী, উদ্ধাখালী, মহাদেও, সোমেশ্বরী নদীতে বালু জমে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ। নদীগুলো খনন না করা হলে তীরবর্তী ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়বে। এ ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেত্রকোনার নেটওয়ার্ক মেম্বার দিলওয়ার খান বলেন, ‘নদী সুরক্ষায় কাজ করছি। নাব্য ফিরিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরীসহ বেশ কিছু নদী খননের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলেই খননকাজ শুরু করা হবে।

আরও পড়ুন

×