ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

রংপুরের ‘দুর্গে’ দুর্গতি জাপার

রংপুরের ‘দুর্গে’ দুর্গতি  জাপার

.

স্বপন চৌধুরী, রংপুর

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০০:৪৯ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৫:২৬

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘জাতীয় পার্টির দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরে চরম দুর্গতিতে পড়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেও ভরাডুবি ঠেকানো যায়নি। রংপুরের ছয়টি আসনে প্রার্থী দিলেও জাপা পেয়েছে মাত্র একটি। আর সারাদেশে সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে জাপার প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ১১টিতে।

জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাড়ি রংপুরে। সে কারণে রংপুর এক সময় ‘লাঙ্গলের ঘাঁটি’ ছিল, দখলে ছিল বৃহত্তর রংপুরের ২২টি আসন। কিন্তু দিনে দিনে তাতে ভাগ বসায় আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগে জাপার দখলে ছিল সাতটি আসন। গত রোববারের ভোটে তারও চারটি হারিয়েছে জাপা।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ২৬ আসনের মধ্যে রংপুর বিভাগে ৯টিতে লড়াই করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তারা হলেন– রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার, রংপুর-৩ জি এম কাদের, নীলফামারী-৩  রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী-৪ আহসান আদেলুর রহমান, ঠাকুরগাঁও-৩ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কুড়িগ্রাম-১ মুস্তাফিজুর রহমান, কুড়িগ্রাম-২ পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা-১ শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও গাইবান্ধা-২ আব্দুর রশিদ সরকার।

এই ৯ প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হয়েছেন তিনজন। তারা হলেন– রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের, ঠাকুরগাঁও-৩ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। বাকি ছয়জনের কেউই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। এ ছাড়া রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনেই জাপার প্রার্থী থাকলেও আর কেউ জিততে পারেননি। এমনকি জামানত হারানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অনেকের।

রংপুর-১ আসনে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ‘নাস্তানাবুদ’ হয়েছেন পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাতিজা সাবেক এমপি হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। জাপা থেকে বহিষ্কৃত এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গা এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘ ৩৭ বছর পর এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হলেন। আর এর মধ্য দিয়ে জাপার ভবিষ্যৎ অন্ধকার রূপ নিল।

লালমনিরহাটের তিনটি আসনকে একসময় ‘জাপার দুর্গ’ বলা হতো। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর সেই দুর্গ ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সেখানে শক্ত ঘাঁটি গাড়ে আওয়ামী লীগ, যার প্রতিফলন ঘটে গত রোববারের ভোটে। গাইবান্ধাও এক সময় ‘জাপার দুর্গ’ ছিল। কিন্তু এবার জেলার পাঁচটি আসনের দুটিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হলেও জয়ী হতে পারেননি জাপার প্রার্থী ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও আব্দুর রশিদ সরকার। বাকি তিনটি আসনেও নৌকার কাছে পাত্তা পাননি জাপার প্রার্থীরা।

একই চিত্র নীলফামারীতেও। জেলার চারটি আসনেই ভরাডুবি হয়েছে জাপার। এরশাদ পরিবারের সদস্য ও নীলফামারী-৪ আসনে এমপি আহসান আদেলুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। সমঝোতার নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেলও ধরাশায়ী।

কুড়িগ্রামের চারটি আসনের দুটি নিয়ে সমঝোতা হলেও শুধু কুড়িগ্রাম-১ আসনে জাপার প্রার্থী বিজয়ী হন। কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাপার আরেক প্রার্থী পনির উদ্দিনের চরম ভরাডুবি হয়েছে। তবে ছাড় পাওয়া ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাপার হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জয়ী হয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনের বেসরকারি ফল অনুযায়ী, রংপুর-৬ আসনে ১,০৮,৬৩৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। আর জাপার প্রার্থী নূর আলম মিয়া পান ৯,০১৬ ভোট (তৃতীয়)। রংপুর-৫ আসনে ১,০৯,৭০৯ ভোট পেয়ে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগ) জাকির হোসেন সরকার। এখানে জাপার প্রার্থী আনিছুর রহমান পান ১০,৩৩৪ ভোট (তৃতীয়)। রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগ) আসাদুজ্জামান বাবলু জয়ী হন ৭৩,৯২৭ ভোট পেয়ে। জাপার প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার পেয়েছেন ১০,৮৯২ ভোট (তৃতীয়)। লালমনিরহাট-২ আসনে ৯৭,২৪০ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নূরুজ্জামান আহমেদ। আর জাপার প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন পেয়েছেন মাত্র ১,১৭৩ ভোট। নীলফামারী-২ আসনে আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান নূর নির্বাচিত হয়েছেন ১,১৯,৩৩৯ ভোট পেয়ে। আর জাপার প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী পেয়েছেন ৩,৮৪৩ ভোট।

নিজের দুর্গে জাপার ভরাডুবি প্রসঙ্গে রংপুরের লোকজন বলেন, এলাকায় মানুষের সঙ্গে জাপা নেতাদের একদম যোগাযোগ নেই। কেউ কেউ বছরের পর বছর এলাকায় যান না, ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেন না। তাই রংপুরের মানুষ লাঙ্গল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এবার জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সারাদেশে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল ২৮৩টি আসনে। এর মধ্যে ১১ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন ২৬৫ জন। কিন্তু দল থেকে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগে ১৯ প্রার্থী সরে দাঁড়ান। এই হিসাবে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে ছিলেন ২৪৬ জন।

এদিকে, ৭ জানুয়ারির ভোট গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার কথা দিয়ে রাখেনি। সরকারের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন হয়েছে। যেখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, সেখানে সুষ্ঠু করেছে। আর যেখানে তাদের লোকজনকে জেতাতে চেয়েছে, সেখানে আমাদের লোকজনকে হারিয়ে দিয়েছে।’ গতকাল সোমবার দুপুরে রংপুর নগরীর স্কাইভিউ ভবনে নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা পাননি বলেও অভিযোগ করেন জাপা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমরা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেইনি, যা আগেও বলেছি। সমঝোতার ২৬ আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিলেও সেখানে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল।’

 

 

আরও পড়ুন

×