স্কুলে ভর্তিতে নানা খরচ দিশেহারা অভিভাবক
ফাইল ছবি
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ১৪:৫৯
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন আলী আজগর। তাঁর ঘরে রয়েছে স্ত্রী ও তিন মেয়ে। চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি স্কুলে বড় মেয়েকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, ফি দিতে হবে ছয় হাজার টাকা। প্রতিমাসে বেতন দেড় হাজার। ডায়েরি, খাতা, ড্রইং খাতা বাবদ দিতে হবে ১ হাজার ৮০০ টাকা। দুই রঙের পোশাক কিনতে হবে; খরচ পড়বে সাড়ে তিন হাজার। আরও লাগবে কালো রঙের জুতা, সাদা মোজা, মেরুন রঙের কোট। দেড় হাজার টাকায় কিনতে হবে ছয়টি বই। সব মিলিয়ে শুরুতেই খরচ হবে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। শুনে চোখ কপালে ওঠে আজগরের।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার এই হতভাগা বাবার মতোই সন্তানদের নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী কিনতে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন অনেক অভিভাবক। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের মতোই চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে শিক্ষা উপকরণের দামও। স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষা উপকরণ কিনতে শিক্ষার্থীপ্রতি খরচ পড়ছে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউনেস্কোর গবেষণার তথ্যমতে, দেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। নগরের শিক্ষাসামগ্রী বিক্রির সবচেয়ে বড় মোকাম আন্দরকিল্লা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বই, খাতা, কলম, পেনসিল, রংপেনসিল, জ্যামিতি বক্স, কলম বক্স, স্কেল, রাবার, ক্লিপবোর্ড, ফাইলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। মানভেদে প্রতিটি খাতার দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। কলমের দাম বেড়েছে প্রতি ডজনে (১২ পিস) ১৫ থেকে ৪০ টাকা। প্রতি ডজন পেনসিলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। ৮০-৯০ টাকার প্র্যাকটিক্যাল খাতার দাম এখন পড়ছে ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা। কিছুটা মোটা সাইজের একটি খাতার দাম ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। এত দাম দিয়ে সন্তানের জন্য চাহিদামতো জিনিস কিনতে বেগ পেতে হচ্ছে অনেক অভিভাবককে।
একই অবস্থা স্কুলব্যাগ, জুতা-মোজার ক্ষেত্রেও। নগরের বৃহৎ পাইকারি রেয়াজউদ্দিন বাজারে গিয়ে অনেক অভিভাবককে সন্তানের জন্য কম টাকায় স্কুলব্যাগ কিনতে একাধিক দোকানে ছুটতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর যেসব স্কুলব্যাগের দাম মানভেদে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকার ওপরে। একটু ভালো মানের ব্যাগ কিনতে গুনতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই থেকে হাজার টাকা।
প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মেয়ের জন্য বই কিনতে আসা চকবাজারের বাসিন্দা চাকরিজীবী মাহফুজ আলম বলেন, ‘পরিচিত একজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে মেয়েকে ভর্তি করেছি। স্কুলে ভর্তি ও পোশাক বাবদ খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকার ওপরে। স্কুল থেকে তিনটি বই দিলেও কিনতে বলেছে আরও ছয়টি। এসব বই প্রতিটির পৃষ্ঠা মাত্র ১৫ থেকে ২৫টি। তবে প্রতিটি বইয়ের দাম ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। মাত্র ছয়টি বই কিনলাম ১ হাজার ৫৮০ টাকায়। এখনও মেয়ের জন্য স্কুলব্যাগ কিনতে পারিনি।’ আরেক অভিভাবক রোকসানা হক বলেন, ‘কয়েকটি দোকানে গিয়েও দেড় হাজারের নিচে একটি ছোট সাইজের স্কুলব্যাগ কিনতে পারিনি।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা অমান্য করছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। কেউ ইচ্ছাকৃত শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়াচ্ছে কিনা– তদারক করতে শিগগির আমাদের টিম কাজ শুরু করবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় যে যেভাবে পারছে শিক্ষার্থী ভর্তিতে গলাকাটা ফি নির্ধারণ করছে। এত টাকা খরচ করে কীভাবে একজন নিম্নমধ্যবিত্ত সন্তানকে পড়াবে? এসবের কারণে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের চাপে এমনিতেই দিশেহারা। সেখানে স্কুলে ভর্তিতে বাড়তি ফি ও শিক্ষা উপকরণের বাড়তি দাম তাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।’