ইতিহাস-ঐতিহ্য
ময়ূরপঙ্খি বজরা আর সাম্পানের মিউজিয়াম

তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো গড়ে উঠছে ‘নৌকা মিউজিয়াম’। স্থাপনার মডেল
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ | ০০:৫২
কোন নৌকার ব্যবহার বেশি, তা নিয়ে নানা মত থাকলেও বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, বিভিন্ন ধরনের নৌকার মধ্যে দেশে ‘সাম্পান’ই সবচেয়ে পরিচিত। শক্ত কাপড়ের পাল উড়িয়ে একসময় পাড়ি দিত নদীর একূল-ওকূল; ছিল যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। বাণিজ্য, বিনোদন, মাছ শিকারেও নৌকা ব্যবহারের ইতিহাস বেশ পুরোনো।
তবে বাহারি নকশা আর কারুকাজের ‘বজরা’, ‘ময়ূরপঙ্খি’ কিংবা ‘পানসি’ এখন আর চোখে পড়ে না। এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই এগুলো অচেনা। শুধু শহরে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়ে নয়; গ্রামের শিশু-কিশোররাও নৌকার দেখা পায় কম। কোন নৌকার কী নাম– বলতে পারে না সবাই।
দেশের নৌপথের ইতিহাসসমৃদ্ধ এই বাহন নিয়ে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো হচ্ছে ‘নৌকা মিউজিয়াম’। নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতেই এ উদ্যোগ। ফৌজদারহাটে ২৫ একর জায়গায়জুড়ে তৈরি এই মিউজিয়ামে থাকবে হারিয়ে যাওয়া সেই ময়ূরপঙ্খি, বজরা, সাম্পান, বাঁশের ভেলা, জোড়া নৌকা ইত্যাদি।
ঝড়ের দিনে মাঝি-মাল্লারা নৌকা নিয়ে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাও তুলে ধরা হবে এই মিউজিয়ামে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ ও অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে এটি। মিউজিয়ামের জন্য তৈরি হচ্ছে শতাধিক নৌকা।
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘একসময় আমাদের নানা ধরনের নৌকা ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিঙি, ময়ূরপঙ্খি, কোষা, পানসি, কোন্দা, কেরায়া, লম্বাপাদি, সাম্পান, বাইচের নৌকা। ব্যবহার ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মাণ করা হতো এসব নৌকা। এখন এগুলো বিলুপ্ত।’
তিনি আরও বলেন, প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহরা শখ করে উঠতেন ময়ূরপঙ্খিতে। এর সামনের দিকটা ময়ূরের মতো বলে নাম দেওয়া হয়েছিল ময়ূরপঙ্খি। এটি চালাতেন চার মাঝি। দুই পালের এই নৌকা ১৯৫০ সালের পর থেকে বিলুপ্তপ্রায়।
আগের দিনে বাংলার জমিদার ও বিত্তশালীরা মাঝেমধ্যে যেতেন নৌকা ভ্রমণে। তাদের কাছে জনপ্রিয় ছিল ‘বজরা’। এতে ঘরবাড়ি বানিয়ে নেওয়া হতো। খাবার-দাবারের সুবিধাও থাকত। কোনো কোনোটিতে পালও থাকত। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বহু আগে থেকেই নৌকার কদর কমে গেছে।
“সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে– ‘যাই’।” রফিক আজাদের সেই কবিতার লাইনের মতো দেশের লোকসাহিত্যের পরতে পরতে আছে সাম্পানের কথা। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়াত সাম্পান। এই নৌকার সামনের দিকটা উঁচু, বাঁকানো এবং পেছনটা সোজা। বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলে ‘সাম’ অর্থ তিন, আর ‘পান’ অর্থ কাঠের টুকরো। সে হিসেবে সাম্পান হলো ‘তিন টুকরো কাঠ’।
নৌকা মিউজিয়ামের উদ্যোক্তা ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৌকা। অনেক নৌকা হারিয়ে গেছে। তবে হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব নৌকা ছিল, সেগুলোর স্মৃতি ধরে রাখতেই নৌকা মিউজিয়াম গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে নৌকার সঠিক ইতিহাস জানাবে এই মিউজিয়াম।’ তিনি জানান, মিউজিয়ামের জন্য এরই মধ্যে বেশ কিছু নৌকা তৈরি হয়েছে। কাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে। আগামী মার্চের মধ্যে মিউজিয়ামটি দর্শনার্থীর জন্য উন্মুক্ত করার আশা প্রকাশ করেন তিনি। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক চট্টগ্রাম আসেন। নৌকা মিউজিয়াম দেশের পর্যটনেও ভূমিকা রাখবে।’
মুক্তিযুদ্ধে নৌকা ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বাংলার নৌপথের যে সোনালি অতীত, তার মূলেই ছিল নানা ধরনের নৌকা। সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে এই মিউজিয়াম। উদ্যোগটি প্রশংসনীয়।’