ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

‘কচ্ছপ’ কমিটির ‘শম্বুক’কাণ্ড

‘কচ্ছপ’ কমিটির ‘শম্বুক’কাণ্ড

ধর্মপাশা উপজেলার সোনামড়ল হাওরের ৩০ নম্বর প্রকল্পে চলছে মাটি ভরাটের কাজ সমকাল

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ | ২২:৪৩

হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধের ঘেরই ফসলের জমিতে বিছানো প্রান্তিক কৃষকের শ্রম আর স্বপ্নের অভয়াশ্রম। তবে সংশ্লিষ্টরা এর ব্যাপকতা অনুধাবন না করায় প্রতি বছরই রক্ষা বাঁধের কাজে নানা অসংগতি চোখে পড়ে। চলতি মেয়াদেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী গত বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন, গণশুনানি ও প্রাক্কলন তৈরির কাজ শেষ করে ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্প সম্পন্নের সময় নির্ধারিত হয় চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এবার স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে ধীরগতির অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া চলমান বাঁধের কাজে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রস্তাবনা, কৃষকদের প্রত্যাশার বিপরীতে প্রভাবশালীদের পছন্দের স্থানে কাজ করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা অনিয়মের কথা জানা গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিন বাঁধের কাজ পর্যবেক্ষণ করে সমকালের সুনামগঞ্জ, ছাতক, ধর্মপাশা ও তাহিরপুর প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
এক প্রকল্প বন্ধ, ২০ ক্লোজারে কাজই হয়নি
নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন সম্পন্ন করার কথা থাকলেও ধর্মপাশা ও মধ্যনগরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণশুনানি ও তৃতীয় সপ্তাহে পিআইসি গঠন করা হয়।
এবার ধর্মপাশা ও মধ্যনগরের চন্দ্রসোনার থাল, ধানকুনিয়া, জয়ধনা, কাইল্যানিসহ গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরাঞ্চলে বাঁধের কাজ চলছে। ধর্মপাশায় ৯৬টি এবং মধ্যনগরে ৩২টি প্রকল্পের মধ্যে চলছে বাঁধের কাজ। জায়গা-সংক্রান্ত ঝামেলায় ধর্মপাশার একটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ ২০টি ক্লোজারের একটিতেও কাজ শেষ হয়নি। এদিকে মধ্যনগরের সব ক’টি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও কাজ শেষ হয়নি একটিরও। সেখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ক্লোজার এখনও অরক্ষিত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য মতে, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ধর্মপাশায় ২৭ ভাগ ও মধ্যনগরের ২১ ভাগ মিলিয়ে সেখানকার মোট ৪৮ ভাগ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, তথ্যের সঙ্গে সত্যের পার্থক্য দৃশ্যমান।
সেখানকার কৃষকরা জানান, ১৫ ডিসেম্বর নিয়ম রক্ষার আনুষ্ঠানিকতায় ধর্মপাশায় তিনটি ও মধ্যনগরে একটি প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করা হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে অন্যগুলোর পিআইসি গঠন ও প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয় দেরিতে। যার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গুরমা হাওরের ২৪ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি মঞ্জু লাল তালুকদার জানান, দিন দশেক কার্যাদেশ পেয়েই কাজ শুরু করেছেন। গাড়ির সমস্যার কারণে কাজে কিছুটা দেরি হচ্ছে। ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ৭২ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি সুবোধ সরকার জানান, খননযন্ত্র আনার জন্য ১ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েও সেটি পেতে দেরি হয়েছে, যার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়।
ধর্মপাশা ও মধ্যনগরে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সুনামগঞ্জ পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী নূর আলম ও জাহাঙ্গীর আলম জানান, পুরো গতিতে কাজ চলছে। হাওর থেকে দেরিতে পানি নামায় জরিপ কাজ ও প্রাক্কলন তৈরিতে বিলম্ব হয়েছে। যার কারণে কমিটি গঠনেও দেরি হয়।
কমিটির অনুমোদনের সঙ্গে ঝুলছে কৃষকের ভাগ্য
ছাতকে পিআইসি গঠন দেরিতে হওয়ায় বাঁধের কাজের স্বাভাবিক ধারা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গত ডিসেম্বরে কাজ শুরুর কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত উপজেলার একাধিক এলাকায় পিআইসি’র অনুমোদন ঝুলে আছে।
গত বুধবার বাঁধ নির্মাণের কাজে কচ্ছপগতির কারণে ক্ষুব্ধ কৃষক ও হাওর বাঁচাও আন্দোলন উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। সংগঠনটির ছাতক উপজেলা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব পিআইসি গঠন করে বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া বাঁধের কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।
১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ছাতকের হাওরাঞ্চলে ৩২টি পিআইসির মধ্যে ২৩টির কাজ চলমান ছিল বলে জানা যায়।  তবে ২২ জানুয়ারির সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেখানে ৩০টি কমিটির কাজ শুরু হলেও উত্তর খুরমা ইউনিয়নের বৈঠাখালের মুখ এবং সিংচাইড় ইউনিয়নের চাউলীর হাওর খালের মুখ বন্ধ করা ও ক্লোজারের কাজের জন্য গঠিত পিআইসি এখনও চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২টি প্রকল্পের অধীনে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে নোয়ারাই, জাউয়াবাজার, চরমহল্লা, দক্ষিণ খুরমা, উত্তর খুরমা ও সিংচাপইড় ইউনিয়নের বাঁধের কাজের জন্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা এমদাদুল হক জানান, উত্তর খুরমা ও সিংচাইড় ইউনিয়নের পিআইসি দুটির চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে।
কাজ বন্ধ, অনিয়ম চালু
তাহিরপুর উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও বাঁধের কাজ শুরু করা নিয়ে কৃষকদের অসন্তোষ কাটেনি। এই উপজেলায় এবার ৮২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সব কমিটি গঠন সম্পন্ন করে কাজ শুরু করতে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যয় করা হয়।
১৮ জানুয়ারির তথ্য অনুসারে জানা যায়, তাহিরপুরের ৮২টি প্রকল্পের কার্যাদেশই তখনও হাতে পায়নি কমিটির সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ৯০ ভাগ প্রকল্পের স্থানে তখন পর্যন্ত মাটিও ফেলা হয়নি। ক্লোজারের কাজ করার ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কমিটির সদস্যরা।
এমন পরিস্থিতিতে উপজেলার সাধারণ কৃষকদের উপস্থিতিতে উপজেলা পরিষদ চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। সে সময় সংগঠনের সদস্য ও সাধারণ কৃষকরা জানান, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশায় যখন বাঁধের কাজ ৩০ থেকে ৪০ ভাগ সম্পন্ন হওয়ার পথে, তখন তাহিরপুরের প্রকল্পগুলোর কার্যাদেশই দেওয়া হয়নি।
বর্তমানে সব পিআইসির অধীনে বাঁধের কাজ পূর্ণ গতিতে চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন। তিনি জানান, এরই মধ্যে ৫০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলার ওই ৮২টি প্রকল্পের মধ্যে মাটিয়ান হাওরের ৩৪, ৩৫ ও ৩৬ নাম্বার প্রকল্পে কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
এ ছাড়া উপজেলার একাধিক প্রকল্পের কাজে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছ থেকে ছাড় পাওয়া বরাদ্দের অগ্রিম টাকা পকেটে তুলে এলাকা ছেড়েছেন কেউ কেউ। 
প্রকৃতির সঙ্গে কখনও সমঝোতা, আবার কখনও তার বৈরিতার বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম। অভাব, দারিদ্র্য আর নানামুখী সংকটের মাঝেও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশের শস্যভান্ডারে জোগান দিতে লড়তে হয় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকদের। সেই ফসল চাষাবাদের কাজে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে ভোগান্তি পৌঁছায় চরমে।
হাওরাঞ্চলের কৃষি ও প্রকৃতি রক্ষার কাজে নিয়োজিত সংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলন, ছাতক উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহ্‌ মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান জানান, প্রতি বছরই বাঁধের কাজ নিয়ে টালবাহানা চলে। সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক নির্দেশনা ও নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। তবে 
সেটি বাস্তবায়নে স্থানীয় পর্যায়ের অসংগতির কারণে ভোগান্তি 
সৃষ্টি হয়। বাঁধের কাজ শুরু করতেই যখন এ অবস্থা। তখন কাজের মান নিয়ে সংশয় থেকে যায়। বিলম্বিত কাজ সময় মতো শেষ দেখাতে গোঁজামিল দেওয়া হয়। এতে বাঁধের কাজে দুর্বলতা থেকে যায়। হাওরাঞ্চলের এই ফসল রক্ষা বাঁধে ফাটল ধরলে কৃষকের কপালে তার দাগ পড়বে।

আরও পড়ুন

×