
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আগুনে পোড়া অভিযান-১০ লঞ্চ - সমকাল
'বাবা তুই বেঁচে থাক, ভালো থাকিস, লেখাপড়া ঠিকমতো করিস'- ছেলে রনিকে কথাগুলো বলতে বলতে নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন মা রিনা বেগম। দশম শ্রেণির ছাত্র রিশাদ বিন সিকদার রনি (১৫) সে দিন বেঁচে ফিরলেও মা ও সঙ্গে থাকা বোন লিনার খোঁজ মেলেনি আজও। তারা বরগুনার বেতাগী উপজেলার করুনা গ্রামের জগলুল বাশারের স্ত্রী-সন্তান। গত ২৩ অক্টোবর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আগুন লাগা অভিযান-১০ লঞ্চে এমন ঘটনা ঘটে।
সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুনের ঘটনায় প্রশাসনের তালিকায় নিখোঁজ ৩০ জনের অন্যতম রিনা বেগম (৩২) ও লিনা (১৪)। আর তাদের সন্ধান মিলবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বজনরা। আগুনে পুড়ে অঙ্গার মরদেহের ডিএনও প্রতিবেদনই এখন শেষ ভরসা। ডিএনএ প্রতিবেদনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তারা।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, লঞ্চে আগুনের ঘটনায় ৪৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুড়ে অঙ্গার ২৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। বরগুনা সদরের পোটকাখালী গ্রামের খকদোন নদীর তীরে পৃথক ২১টি কবরে দাফন করা ২৩টি মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। শিশুসহ দুই নারীর লাশ দাফন করা হয়েছে এক সঙ্গে। সন্তানের মরদেহ আঁকড়ে থাকায় তা পৃথক করা যায়নি। তারা মা-সন্তান বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, গত ২৯ ডিসেম্বর অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ মরদেহের পরিচয় শনাক্তে ৪৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে ডিএনএ প্রতিবেদন পেতে দুই মাস সময় লাগে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রতিবেদন পেলে কিছু মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হবে।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার রাত থেকে শুরু হওয়া উদ্ধার অভিযান ২ জানুয়ারি স্থগিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রশাসনের তালিকায় অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ যাত্রী ৩০। তবে রেড ক্রিসেন্টের ঝালকাঠি ইউনিটের যুব প্রধান মশিউর রহমানের দাবি, তাদের তালিকায় এখনও ৫০ জন নিখোঁজ। তাদের খোঁজে আসা স্বজনদের কাছ থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
মশিউর বলেন, ৫০ জনের তালিকায় ৩৩ জনের স্বজনরা এখনও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অপর ১৭ জনের স্বজনদের মোবাইল ফোনে বারবার কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায় না। এ কারণে তাদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, অনেক মানুষই পুড়ে শেষ। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর দাফন করা অজ্ঞাতপরিচয় কিছু লাশের পরিচয় মিলবে হয়তো। আবার অনেকের মতে, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পানির বেগে পোড়া কঙ্কাল ও হাড় নদীতে চলে গেছে।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন লিডার শহীদুল ইসলাম বলেন, উদ্ধার মরদেহের বেশিরভাগই ছিল কঙ্কাল। ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়া তাদের পরিচয় শনাক্তের উপায় নেই।
তবে অনেকেরই বিশ্বাস, তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজন ফিরে আসবেন। এমনই একজন বরগুনার বেতাগী উপজেলার মোকামিয়া গ্রামের খদিজা বেগম। তিনি জানান, এখনও তার মনে হচ্ছে, স্বামী আরিফুল (৩৫) ও মেয়ে কুলসুম (৪) ঢাকায় বেড়াচ্ছেন। যে কোনো সময় বাড়িতে ফিরবে। বাবার সঙ্গে ঢাকায় ফুফু বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল চার বছরের কুলসুম। বাড়িতে ফেরার পথে লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ হয় তারা।
পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী গ্রামের মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা পপি (৩৭)। ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করে অষ্টম শ্রেণি পড়ূয়া মেয়েসহ মা ও এতিম ভাইবোনের ব্যয় বহন করতেন তিনি।
লঞ্চের আগুনের ঘটনায় পপি নিখোঁজ। তার মেয়ে বলছে, মা ফিরে এলে নফল নামাজ পড়ব।
অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিনটি তদন্ত কমিটি এখনও প্রতিবেদন দেয়নি। অথচ প্রত্যেককে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। শুধু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলম জানান, তারা সাত দিন সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্য ফিরোজ কুতুবী জানান, তারাও সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন।
বিআইডব্লিউটিএর তদন্তের বিষয়ে জানতে বরিশাল বন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
গত বুধবার বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে দগ্ধ ১২ জন লঞ্চযাত্রী চিকিৎসাধীন। সেখানে মোট ৭২ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল।
মন্তব্য করুন