- সারাদেশ
- ইভিএম জটিলতায় ছন্দপতন
ইভিএম জটিলতায় ছন্দপতন

ইভিএমে জটিলতায় ভোট দিতে এসে ভোগান্তি হতে দেখা যায়- সমকাল
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) জটিলতায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের ভোটে অনেকখানি ছন্দপতন হয়েছে। ভোটের মাঠে এ নিয়ে দিনভর ছিল নানা আলোচনা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এ ছাড়া ইভিএম বুঝতে বয়স্ক ভোটারদের সময় বেশি লাগায় ধীরগতির কারণে অনেক কেন্দ্রে ভোটের সারি লম্বা হতে থাকে।
প্রথমবারের মতো এই সিটির সব কেন্দ্রে নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। আগে থেকেই ইভিএম নিয়ে নানা শঙ্কা ছিল বিশ্নেষকদের। ইভিএম অত্যন্ত দুর্বল হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন কেউ কেউ। গতকাল রোববার সর্বত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলেও ভোটার, প্রার্থী, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও সমর্থকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইভিএম। তবে তরুণ ও নতুন ভোটারদের ইভিএমে ভোট দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
ভোট গ্রহণে ধীরগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী। দুপুরের আগেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ভোট গ্রহণে ধীরগতির কথা জানিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করেন, ত্রুটিপূর্ণ ইভিএমের কারণে ভোট নিতে দেরি হচ্ছে।
যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার দুপুরে বলেন, ভোট হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে; গোলযোগহীন এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিও তুলনামূলক ভালো। তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে তিনি দেখেছেন, চার ঘণ্টায় ভালো ভোট কাস্ট হচ্ছে। ভোটারের উপস্থিতিও ভালো রয়েছে।
তিনি বলেন, কোথাও বেশি, কোথাও কম ভোট পড়েছে। সকালের দিকে কয়েকটি কেন্দ্রে ধীরগতি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও মেশিনের সামান্য সমস্যা হলেও টেকনিক্যাল লোকজন তা দ্রুত সেরে নিয়েছে।
২০১১ সালের নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হলেও এবারই প্রথম এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের এক হাজার ৩৩৩টি বুথে একযোগে ইভিএমে ভোট হয়েছে।
ভোট কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, আঙুলের ছাপ না মেলায় দীর্ঘ অপেক্ষার পর বুথে ঢুকেও অনেক ভোটার ভোট না দিতে পেরে ফিরে যান। প্রিসাইডিং অফিসাররা বলছেন, আঙুলের ছাপ না মিললে বা মেশিন সেটি গ্রহণ না করলে তাদের কিছু করার নেই। তারপরও আঙুল কিংবা মেশিন পরিস্কার করে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ফুলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তিনবার চেষ্টা করেও আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ভোটার রুহুল হোসেন (৬৮)। একই অভিযোগ করেন কেন্দ্রে এক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নাবির আহমেদ। তিনি জানান, আঙুলের ছাপ না মেলায় কমপক্ষে ১০ জন ভোট না দিয়ে ফিরে গেছেন। একই অভিযোগ তৈমূরের পোলিং এজেন্ট কবীর হোসেনেরও।
তবে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার শেখ ময়নুল হক আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট না দিতে পারার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি ইভিএম মেশিনের, আমাদের এখানে তেমন কিছু করার নেই।
সকালে ভোট শুরুর পরপরই নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দেওভোগের শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন মোহাম্মদ আলী। লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'এখানে এসেছি সাড়ে ৮টায়, এখন সাড়ে ১০টা। কয়েকটি লাইন দ্রুত এগোচ্ছে, আমাদেরটা টানছে আস্তে।' অন্তত ৪৫ মিনিট ধরে পাশের আরেকটি লাইনে রয়েছেন বিনয় নামে এক ভোটার। জাকির হোসেন নামে আরেকজন ভোট দেওয়ার জন্য আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় থাকার কথা বললেন। শিশুবাগ বিদ্যালয়ে মোট দুটি কেন্দ্রে ভোটার চার হাজার একশর কিছু বেশি।
এ ছাড়া কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, পছন্দের প্রার্থীকে দ্রুত ইভিএমে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন ভোটাররা। কিন্তু কতক্ষণে ভোট দিতে পারবেন, সেই ধারণা তারা করতে পারছেন না। প্রতিটি ভোট শেষ করতে মিনিটখানেক লাগার কথা।
শিশুবাগ কেন্দ্রের একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানান, প্রথম দুই ঘণ্টায় আঙুলের ছাপে বিভ্রাট হয়েছে দু'জনের। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটের ব্যবস্থা করা গেছে। এই কেন্দ্রেই ভোট দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ভোটদানে ধীরগতির খবর পাওয়ার কথা বলেছেন তিনি। আইভী বলেন, অনেক স্থান থেকেই খবর পাচ্ছি ভোটের লাইন ধীরগতিতে আগাচ্ছে। ৫, ১৭, ১৮, ২০ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচুর মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ ছাড়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডে কদমতলিতে একটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিন নষ্ট হওয়ার খবর পেয়েছেন তিনি। পরে তারা জানিয়েছেন, ঠিক হয়েছে।
দুপুর পর্যন্ত কোনো কোনো বুথে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট নেওয়া হয়েছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, কোনো কোনো বুথে নারী ও বয়স্কদের কারণে কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে। দুপুর ১২টার দিকে আদর্শ স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডিসি। তিনি বলেন, পুলিশ সুপার ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র তিনি ঘুরে দেখেছেন। কিছু কিছু বুথে একটু দেরি হলেও শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে মানুষ ভোট দিচ্ছে।
এ দিকে আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোটারকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন এক কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা। আদর্শ স্কুল নারী কেন্দ্রে আনসার সদস্যরা বলেছেন, সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসুন। নতুবা দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ওই কেন্দ্রে মনোয়ারা বেগম সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ভোট দিতে আসেন। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যখন আঙুলের ছাপ দিতে গেলেন, তখন মিলছিল না। সব আঙুলে কয়েকবার চেষ্টা করেও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা ব্যর্থ হচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তারা বলেন, একটু পরে আসেন। এ সময় আনসার সদস্য নুরজাহানের পরামর্শে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসেন মনোয়ারা। ফের সব আঙুলে চেষ্টা চলে। এবারও ব্যর্থ! এরপর ভোট গ্রহণ কর্মীরা যত্ন করে মনোয়ারার আঙুলে জেল মাখেন। এরপর আবার চেষ্টা করেও সফলতা পাননি। এ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা কিছুটা বিরক্ত হলে বুথের ভেতর পাশে এক জায়াগায় দাঁড় করিয়ে মনোয়ারাকে অপেক্ষা করতে বলেন। আবার চেষ্টার পরও আঙুলের ছাপ মেলেনি। হতাশ হয়ে ১২টার দিকে ভোট না দিয়েই বেরিয়ে যান মনোয়ারা। এ ব্যপারে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা জানান, বয়স্ক প্রায় সব ভোটারেরই সমস্যা হচ্ছে। তিনজনের ১০ মিনিট করে চেষ্টায় সফল হয়েছেন। মনোয়ারারটা একেবারেই সম্ভব হয়নি।
মনোয়ারা বলেন, কাজ করলে তো হাতের রেখা কিছুটা মুছে যায়। এখন আমার কী করার আছে? কষ্ট করে এসেও ভোট দিতে পারলাম না।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শামছুল হক আঙুলের ছাপ না মেলাসহ ইভিএমে ধীরগতির কথা স্বীকার করে বলেন, মক ভোটে মাত্র তিনজন ভোটার এসেছিলেন এই কেন্দ্রে। তাই সমস্যা হচ্ছে অনেকের। এই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ২৫৫।
ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তৈমূর আলম খন্দকার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দেওভোগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'ইভিএমের কারণে ভোট দিতে দেরি হচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মানুষ ভোট দিতে পারছে না। ত্রুটিপূর্ণ মেশিনের কারণে এ ভোগান্তি হচ্ছে।'
মন্তব্য করুন