দাউদ, বিখাউজ, একজিমা। নেই চিন্তা। করবেন মাত্র পাঁচ টাকা খরচা। আর তাতেই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে সারবে চুলকানি। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল থেকে মলম, সবই আবার বিনা পয়সায়। এই যুগেও 'শায়েস্তা খাঁ' আমলের দরে চর্মরোগের এমন চিকিৎসাসেবা মিলছে আমেরিকান হাসপাতালে। নাম 'আমেরিকান' হলেও চিকিৎসালয়টির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বন্দরনগরী চট্টলায়। নগরের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় চর্ম ও সামাজিক স্ব্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সরকারি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আমেরিকান হাসপাতাল নামেই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে বেশি চেনা।
এটিই চট্টগ্রাম অঞ্চলের একমাত্র হাসপাতাল যেখানে চর্মরোগেরই শুধু চিকিৎসা হয়। চিকিৎসার এমন সহজলভ্যতার কারণে হাসপাতালটি দরিদ্র ও অসহায় চর্ম রোগীদের কাছে যেন 'অন্ধের নড়ি'। জটিল সব চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন শুধু বহির্বিভাগেই ছুটে আসেন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী।
তবে এমন আশাজাগানিয়া পটভূমির বিপরীতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আছে চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে! অযত্ন ও অবহেলার ছাপ হাসপাতালটির রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ। চিকিৎসালয়টিতে থাকার কথা ৩১ পদে জনবল। তবে অনেক বছর ধরে খালি অর্ধেকেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ। প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতির জোগান না থাকায় তালাবদ্ধ একমাত্র পরীক্ষাগারে (ল্যাব) জমছে ধুলা। রোগীদের বসার জন্য নেই বাড়তি চেয়ারের ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত বাতি ও পাখা। ভেতরের কয়েকটি অংশে ধসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। বেশকিছু কক্ষের কাচ পড়ে আছে ভাঙা।
প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক রোগীকে সামাল দিতে হয় মাত্র ছয় চিকিৎসককে। সিনিয়র কনসালট্যান্টের একটি পদ থাকলেও সেটিও দীর্ঘদিন ধরে খালি। হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী। সিনিয়র স্টাফ নার্স, আয়া, অফিস সহকারীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু পদেও লোক নেই।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির তদারকি করে। সম্ভাবনাময় এই হাসপাতালকে টিকিয়ে রাখতে জনবল, অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার চিঠি পাঠানো হলেও হাসপাতালটির ভাগ্যের পালে এখনও লাগেনি হাওয়া। ২০০৮ সালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির
সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে কয়েক পৃষ্ঠার প্রস্তাবনাসহ মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠানো হলেও সেটি রয়েছে তিমিরেই।
১৯৫৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চর্ম ও যৌন রোগ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ও দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ২ দশমিক ১৪ একর জায়গায় এটি প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথম দিকে শুধু বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের চর্ম ও যৌন রোগ পরীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল এখানে। পরে সব মানুষের জন্য হাসপাতালটি খুলে দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীর অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে এলে চিকিৎসা নিতে ছুটে যেতেন আমেরিকান হাসপাতালে। বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কর্মচারীরা স্বাস্থ্যসেবা দিতেন বলেই এটি আমেরিকান হাসপাতাল নামে পরিচিতি পায়।
হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গাদাগাদি করে একসঙ্গে অনেক রোগী লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসককে দেখানোর অপেক্ষায় সময় গুনছেন। এখানে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীরা চিকিৎসাসেবা নেন। গেট খোলার আগেই হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন অসংখ্য রোগী। গেট খোলার পরপরই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিকিট কাউন্টারের সামনে। টিকিট নিতে কে কার আগে লাইনে দাঁড়াতে পারেন, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতাও। রোগীদের সুবিধার্থে নারী ও পুরুষদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা লাইন। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মাত্র পাঁচ টাকা খরচায় প্রত্যেকে সংগ্রহ করেন বহুল কাঙ্ক্ষিত টিকিট।
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক মো. নুরুন্নবী বলেন, 'বাইরে গিয়ে চিকিৎসক দেখানোর সামর্থ্য নেই। তাই পাঁচ টাকায় টিকিট কেটে এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। এবারসহ চারবার আসলাম এখানে।'
বাসাবাড়িতে কাজ করা হালিশহর বড় পোলের বাসিন্দা পপি বেগম বলেন, 'ছোট মেয়ের গলায় ও হাত-পায়ে বেশকিছু লালচে বিচি উঠেছে। মাত্র পাঁচ টাকায় চিকিৎসক দেখানোর পর ওষুধও পেয়েছি দুই রকম। এখানে এই সুযোগ না থাকলে আমার মতো অনেকেই চিকিৎসা করাতে পারতেন না।'
সুমন পালিত নামের আরেক সেবাগ্রহীতা বলেন, 'পাঁচ টাকায় চিকিৎসা পাওয়ার এমন সুবিধা গরিব-অসহায় মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। তবে এখানে যে পরিমাণ রোগীর চাপ সে তুলনায় চিকিৎসক নেই।'
এ ব্যাপারে হাসপাতালটির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা ডা. সঞ্জয় প্রসাদ দাশ বলেন, 'নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেই চলছে হাসপাতালটির চিকিৎসা কার্যক্রম। রোগীর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় মাত্র ছয়জন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। মাত্র পাঁচ টাকায় ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি ওষুধ পাওয়ার সুযোগ থাকায় হাসপাতালটি এই অঞ্চলের অনেকের ভরসার স্থানে পরিণত হয়েছে। একমাত্র ল্যাবটি বন্ধ থাকায় রুটিন পরীক্ষগুলো করা যাচ্ছে না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকটও খুবই প্রকট। '
চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, 'এক সময় এই হাসপাতালে কিছুই ছিল না। হাসপাতালের ভেতরে ও সামনের মাঠে গরু চরানো হতো। বিকেলে ও রাতে এখানে সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের আড্ডা বসত। ছিল না কোনো সীমানা প্রাচীর। এখন চারপাশে দেয়াল করে দেওয়ায় সেই চিত্র পাল্টেছে। জনবলসহ নানা সমস্যা এখনও আছে।'

বিষয় : পাঁচ টাকায় চিকিৎসা ওষুধও বিনা পয়সায় 'আমেরিকান' হাসপাতাল

মন্তব্য করুন