লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাড়ছে বেশি লবণসহিষ্ণু গেওয়া ও গরান গাছ। আর কমছে যে গাছের নাম থেকে এই বনের নাম, সেই সুন্দরী গাছ। এ ছাড়া কমছে কম লবণসহিষ্ণু পশুরসহ কয়েকটি প্রজাতির গাছ। এ অবস্থায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের পুরোনো বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটছে। এ ছাড়া গাছপালার এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীর ওপরও।

এমন অবস্থায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে সুন্দরবন দিবস। ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলাগুলোতে বেসরকারিভাবে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদে ২০১০ সালে লবণাক্ততার সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ৫ পিপিটি, আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৬ পিপিটিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের পানির চাপ বৃদ্ধি ও উজান থেকে মিষ্টিপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে। এ ছাড়া পশুর নদের হাড়বারিয়া এলাকায় ২০১৩ সালে পলি পড়ার পরিমাণ ছিল ৯ সেন্টিমিটার, পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২-এ। নদীটির করমজল এলাকায় আগে ছিল ১৯ সেন্টিমিটার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯-এ।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৯ সাল থেকে 'ইমপ্যাক্ট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অন ফ্লোরাল বায়োডাইভারসিটি ইন দ্য সুন্দরবন' শিরোনামে একটি গবেষণা করছে, যা শেষ হবে ২০২৩ সালে। ওই গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনে বেশি লবণসহিষ্ণু গেওয়া, গরান, খলসি ও বাইন গাছ বেড়ে গেছে।

বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনার বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আ স ম হেলাল সিদ্দিকী জানান, তারা গবেষণা করে দেখেছেন, সুন্দরবনে গেওয়া গাছের চারা অনেক বেড়ে গেছে। ১৯৮৫ সালে সুন্দরবনে গেওয়া গাছ ছিল ১৬ শতাংশ এলাকায়। আর গত বছর গেওয়া গাছের চারা পাওয়া গেছে বনের ৫০ শতাংশে। ভবিষ্যতে যদি এভাবে গেওয়া গাছের চারা বেড়ে যায়, তাহলে তা খুবই উদ্বেগের।

তিনি জানান, গেওয়া গাছের বীজের পরিমাণ অনেক বেশি। এর পাতা, গাছ ও বীজে এক ধরনের আঠা রয়েছে। সে কারণে হরিণ বা অন্য কোনো প্রাণী গেওয়া গাছের চারা বা পাতা খায় না। এ ছাড়া খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল আগে কয়েক লাখ মণ গেওয়া গাছ সংগ্রহ করত। দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিও কিছু গেওয়া গাছ নিত। এখন গেওয়া আহরণ বন্ধ রয়েছে। গেওয়া গাছে পাখিও বাসা বাঁধে কম। কারণ, এর ডালপালা কম।

ড. হেলাল সিদ্দিকী আরও জানান, গেওয়া গাছের পাশাপাশি বেশি লবণ সহনশীল গরান গাছও বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে বন থেকে গরান আহরণ বন্ধ রয়েছে। ফলে বনজুড়ে গেওয়া ও গরানে আধিক্য বাড়ছে। এ দুটি গাছ বেড়ে যাওয়া সুন্দরবনের জন্য উপকারী নয়। এ ছাড়া বাইন গাছও বেড়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, খলিসা, ঝানা, মঠগরান, নুনিয়া, ভাতকাঠিসহ কম লবণসহিষ্ণু বেশ কয়েকটি প্রজাতির গাছ কমে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরীসহ ১০টি গাছের চারা গজানোর হার কমেছে। সুন্দরী গাছের আগামরা রোগ জেঁকে বসেছে। বনের কমপক্ষে ৩৮ শতাংশ সুন্দরী গাছ আগামরা ও ৫০ শতাংশ পশুর গাছ হার্ট রট রোগে আক্রান্ত।

ড. হেলাল সিদ্দিকী জানান, রোগাক্রান্ত সুন্দরী গাছ কম ফল-বীজ ধারণ করছে এবং চারার পরিমাণও কমে গেছে। স্থায়ী ও অস্থায়ী নমুনা প্লটগুলোতে গবেষণা করে দেখেছেন, সুন্দরী গাছের চারার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে চারা ও বড় গাছের পরিমাণ বেশি ছিল, সেখানে কমে গেছে। আগামরা সুন্দরী গাছে বীজ হয় কম। যে পরিমাণ বীজ জন্মায়, তার মধ্য থেকেও অঙ্কুরিত হয় কম। ওই চারার টিকে থাকার হারও কম। হার্ট রট রোগে আক্রান্ত পশুর গাছে বীজ ও চারা কম হচ্ছে। পশুর গাছের অনেক চারা, ফল, পাতা ও বীজ হরিণ খেয়ে ফেলে।

বন গবেষণায় নিযুক্ত এই কর্মকর্তা আরও জানান, পলি পড়ার হার বেড়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় গাছের শ্বাসমূল ঢেকে যাচ্ছে। এর ফলে কেওড়া গাছ মারা যাচ্ছে। বনের কটকা এলাকায় আগে যে পরিমাণ কেওড়া গাছ ছিল, এখন তা নেই। কেওড়া গাছ মরে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কটকা বন অফিসের পেছন পাশে বিশাল এলাকায় গেলে এ অবস্থা দেখা যাবে। আগে যেখানে হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল, এখন সেখানে আর আগের মতো হরিণ দেখা যায় না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী সমকালকে বলেন, সুন্দরবনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি পানি ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি। এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরী, পশুর, গোলপাতা ও খলিসা গাছের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে বেশি লবণসহিষ্ণু গরান, গেওয়া, কেওড়া, বাইন গাছ, কালিয়ালতা, গিলালতাসহ লতাগুল্ম বাড়ছে। এ অবস্থায় সুন্দরবনের পুরোনো জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন ঘটছে।

তিনি তার গবেষণার উদ্ৃব্দতি দিয়ে জানান, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে অনেক গাছের বীজ আগের মতো অঙ্কুরিত হচ্ছে না। উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবর্তনের কারণে প্রাণী সম্প্রদায়েরও পরিবর্তন ঘটছে। বন্যপ্রাণীগুলো তাদের জায়গা পরিবর্তন করছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত জানান, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনের কিছু কিছু গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির সমকালকে বলেন, যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুন্দরবন গড়ে উঠেছিল, তা এখন আর নেই। যে গাছের নামানুসারে বনের নাম, সেই সুন্দরী গাছ কমে গেছে। বেশি লবণসহিষ্ণু গাছ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সুন্দরবনের যে বিশেষত্ব, তা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বনে সুন্দরী গাছ কমে গেছে।

এ ব্যাপারে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন সমকালকে বলেন, আগে যেখানে সুন্দরী গাছ ছিল, এখন তার অনেক জায়গায় অপেক্ষাকৃত খাটো গেওয়া ও গরান গাছ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছপালার এই পরিবর্তনের প্রভাব বন্যপ্রাণীর ওপরও পড়ছে। যেসব পশুপাখি, কীটপতঙ্গ বনের বিভিন্ন ফুল-ফলের ওপর নির্ভরশীল ছিল- তার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উজান থেকে পশুর ও বলেশ্বর নদ দিয়ে মিষ্টিপানির প্রবাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই।