- সারাদেশ
- হাজারী গুড়ের নামডাক
হাজারী গুড়ের নামডাক

খেজুর রস থেকে বিশেষ ফর্মুলায় তৈরি অন্যরকম এক গুড়। সাত পুরুষ আগের হাজারী প্রামাণিকই ছিলেন ওই গুড়ের কারিগর। সেই থেকে নাম 'হাজারী গুড়'। বিশেষত্ব হলো, এই গুড় ভাঙলেও পাউডারের মতো বাতাসে মিশে যায়। মানিকগঞ্জের হাজারী গুড়ের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে এখন বিভুঁইয়ে।
কথিত আছে, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথও এই গুড় খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বংশ পরম্পরায় সেই ঐতিহ্য অটুট রাখতে সচেষ্ট হাজারী পরিবার। ওই বংশের ২৩ পরিবারকে গুড় তৈরির জন্য 'হাজারী' লেখা সিল ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া আছে। এর বাইরে কারও 'হাজারী গুড়' তৈরির বৈধতা নেই।
তারপরও অনেকেই গোপনে নকল হাজারী গুড় তৈরিতে মেতেছেন। কয়েকশ বছরের 'নামডাক' বিনষ্ট করতে অসাধু ব্যক্তিরা তৈরি করছে নকল হাজারী গুড়। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে হাজারী পরিবারের কতিপয় সদস্য। গুড়ের ওপর মারার জন্য হাজারী লেখা সিল ভাড়া দিচ্ছেন ওই পরিবারের সদস্যরাই। প্রশাসনের কঠোর নজরদারির পরও মানিকগঞ্জে নকল হাজারী গুড় বাজারজাত চলছে। হাজারী গুড়ের দাম নিয়েও রয়েছে লুকোচুরি।
মোজাফ্ফর মোল্লা জানান, তার মা মমতাজ বেগম বাবার ওয়ারিশের ১৩ বিঘা জমির বিনিময়ে হাজারী গুড়ের সিলের উত্তরাধিকার হয়েছেন। নানাবাড়ি থেকে মায়ের ১৩ বিঘা জমির বিনিময়ে ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়ের সিল পান তারা। হাজারী লেখা সিল ব্যবহারের অনুমতি ও গুড়ের মান বজায় থাকছে কিনা জানতে চাইলে হাজারী পরিবারের সদস্য রহিজ হাজারী বলেন, পরিবারের সদস্যরা এখন গুড় বানাতে চায় না, তাই বাইরের লোক দিয়ে গুড় তৈরি করতে হচ্ছে। যাদের কাছে হাজারী সিল দেওয়া হয়েছে, তারা গুনগত মান সঠিক রেখে গুড় তৈরি করছেন।
মানিকগঞ্জের গোপীনাথপুর মজমপাড়া গ্রামে আব্দুল বারেকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে তৈরি হচ্ছে হাজারী গুড়।
তিনি জানান, গুড় তৈরির জন্য হাজারী পরিবারের সদস্য রহিজ হাজারীর কাছ থেকে তিনি গুড়ের ওপর মারার জন্য সিল এনেছেন। এই গুড় তৈরি করে তিনি এক হাজার টাকা কেজি দরে রহিজ হাজারীর কাছে বেচেন। রহিজ হাজারী প্রতিকেজি গুড় বিক্রি করেন এক হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা করে।
তিনি আরও বলেন, তার মতো অনেকেই হাজারী না হয়েও সিল ভাড়া নিয়ে হাজারী গুড় তৈরি করছেন। এক হাজার টাকার নিচে হাজারী গুড় বিক্রি করলে তাতে রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে তৈরি করতে হয়। কারণ এক কেজি ভালো মানের হাজারী গুড় তৈরি করতে ১০ থেকে ১২ কেজি রসের প্রয়োজন। এর সঙ্গে শ্রম ও জ্বালানি রয়েছে।
জসিম মোল্লা নামের এক গাছি জানান, হাজারী গুড়ের চাহিদা এতই বেশি যে, কয়েক মাস আগেই অর্ডার দিতে হয়। নামিদামি মানুষ গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো গুড় তৈরি করা যায় না।
নকল গুড়ের দাপট
মানিকগঞ্জ জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল সম্প্রতি গোপীনাথপুর ও বাল্লা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে অভিযান চালান। সেখানে দেখা যায়, খেজুর রসের নামগন্ধও নেই। তারপরও তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়। দিনের বেলায় খেজুর গাছের যে রস পাওয়া যায়, তাকে ঝড়া বলে। অসাধু ব্যক্তিরা ঝড়ার সঙ্গে চিনি ও চুন মিশিয়ে তৈরি করছেন খেজুর গুড়। বাজারের এসব গুড় বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে।
নকল গুড় তৈরির জন্য রাজশাহী থেকে এসেছেন সেন্টু আলী।
তিনি জানান, তারা পাঁচজন বাল্লা ইউনিয়নের গোরাইল গ্রামে একটি জমি ভাড়া নিয়ে গুড় তৈরির কারখানা দিয়েছেন। প্রতিদিন এখানে পাঁচ থেকে ৬ মণ গুড় তৈরি হয়। ৫০ কেজি খেজুরের রসের সঙ্গে ১২০ কেজি চিনি মিশিয়ে তারা গুড় তৈরি করছেন। এই গুড় বাজারে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল লতিফ জানান, হাজারী গুড় মানিকগঞ্জের ব্র্যান্ড। এর সুনাম ও গুণগত মান ধরে রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাঝেমধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে।
মন্তব্য করুন