কুয়াশামাখা ভোর। তখনও ভাঙেনি রাতের নীরবতা। প্রথমে যশোর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের খাজুরা বাজার। সেখান থেকে মেঠো পথ ধরে আরও কয়েক কিলোমিটার, গন্তব্য বন্দবিলা গ্রাম। দু'পাশে খেজুরগাছে ঠাসা রাস্তার মুগ্ধতা পেরিয়ে মন্টু মিয়ার বাড়ির উঠানে পৌঁছতেই চোখ আটকে গেল। বড় চুলায় টিনের তাফালে রস জ্বাল দিচ্ছেন মন্টু। স্ত্রীসহ অন্য স্বজনরাও শীতের সকালে ঘাম ঝরাচ্ছেন এই কাজে। চারপাশে দাঁড়িয়ে রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরির প্রক্রিয়া চোখের ফ্রেমে ধরে রাখছেন বেশ কয়েকজন।
কাজে মনোযোগ রেখেই মন্টু মিয়া বলা শুরু করলেন, 'ভেজাল দিই না। তাই দূর-দূরান্ত থেকে গুড়-পাটালি নিতে মানুষ আমার বাড়িতেই ছুটে আসেন। আমি ক্রেতাদের সামনেই রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করে দিই।' উঠানে দাঁড়ানো সাইফুল আলম জানালেন, ঢাকায় থাকেন তিনি। প্রতি শীতে বাড়িতে এলে এখান থেকে খেজুর গুড় ও পাটালি নিয়ে যান।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাশরুর রহমান বলেন, 'যশোরে বাড়ি হওয়ায় প্রতি শীতেই আমার কাছে স্বজন-সহকর্মীদের নলেন পাটালির চাহিদা থাকে। ভেজালের ভিড়ে আসল গুড় কেনা নিয়ে থাকি দুশ্চিন্তায়। তাই বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে গুড় সংগ্রহ করতে হয়।'
নলেন গুড়, পাটালি ও ঝোলা গুড়ের জন্য বিখ্যাত এ অঞ্চল। এখানকার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সারি সারি খেজুরগাছ। কার্তিক শুরুর পরপরই খেজুরগাছ ছেঁটে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি নিতে থাকেন এই অঞ্চলের গাছিরা। মাটির ভাঁড়ে রাতভর সংগ্রহ করা হয় রস। ভোরের আলো ফোটার আগেই কুয়াশা ভেদ করে গাছিরা গাছ থেকে রসভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে সেই রস জ্বালিয়ে তৈরি করেন গুড়-পাটালি। নলেন গুড় পাটালির মধ্যে নারিকেল কোরা, তিল ভাজা মেশালে স্বাদ হয় অন্য রকম। ভেজালের দাপটে যশোরের এই নলেন গুড়ের স্বাদ পাওয়া এখন কঠিন কাজ।
মনিরামপুরের হরিদাসকাটি গ্রামের গাছি শংকর দাস ৪০ বছর ধরে খেজুরের গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, 'আমার ৩৮টি খেজুরের গাছ। এ বছর কাঁচা রস ২০০ টাকা ভাঁড়, গুড় ২৫০ টাকা এবং পাটালি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে বেচেছি। তবে ক্রেতার চাদিহা পূরণে গুড়ের রং উজ্জ্বল করতে অনেকে চিনি মেশায়। আবার কোথাও কোথাও মেশানো হয় ফিটকারি ও হাইডোজের মতো রাসায়নিক দ্রব্য। এতে খেজুরের গুড়-পাটালি তার মৌলিক স্বাদ-গন্ধ হারাচ্ছে।'
৩৬ বছর ধরে খেজুরের গাছ কাটছেন বাঘারপাড়ার রোস্তমপুর এলাকার চাষি আয়ুব আলী। তিনি বলেন, 'ভেজাল গুড়-পাটালি চকচক করে। গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশালে পাটালি খুব শক্ত হয়। রসালো থাকে না। গুড়ে হাইড্রোজ এবং ফিটকিরি দিলে পাটালির রং সাদা এবং ভীষণ শক্ত হয়ে যায়। খেজুরের খাঁটি পাটালি চকচক করে না। রং কিছুটা লাল-কালচে হয়। পাটালি নরম এবং রসালো হয়।'
বাঘারপাড়ার হাবুল্লা গ্রামের গাছি শামীম রেজা বলেন, 'আমি এবার ৫২টি গাছ কাটছি। এর মধ্যে ৪৮টি গাছ নিজের। চারটি গাছ বর্গা নিয়েছি। প্রতিদিন ১০-১২ ভাঁড় রস হয়। গত বছর কাঁচা রসের ভাঁড় ১৫০ টাকা করে বেচেছি। এ বছর ২০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এক দিন গাছ কাটলে যে রস পাওয়া যায়, তা দিয়ে আমার আট কেজি গুড়-পাটালি হয়। গুড় ২০০ টাকা এবং পাটালি ৩৫০ টাকা বিক্রি করেছি। যারা ভেজাল গুড় তৈরি করেন, তারা একটু কম দামে বেচতে পারেন। অনেক ক্রেতা মান যাচাই না করেই কম দামের গুড় কেনেন। '
যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক নাজমুস সাদিক বলেন, শীতে খেজুর গুড়ের পিঠা-পায়েশের স্বাদ অতুলনীয় হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে সুক্রোজ থাকে, যা বাত বা প্রদাহভিত্তিক রোগ বাড়ায়। আর কৃত্রিম চিনি, সোডা বা রং ব্যবহারে তৈরি গুড় স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই গুড় খেলে কিডনি ও পাকস্থলীতে জটিল রোগ হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, যশোরে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুরগাছ আছে। এর মধ্যে রস হয় এমন খেজুরগাছের সংখ্যা তিন লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি। সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ সদর, মনিরামপুর, শার্শা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়ায়। একটি গাছ থেকে মৌসুমে গড়ে প্রায় ১৫০ লিটার রস পাওয়া যায়। ওই রস থেকে প্রায় ১৫ কেজি গুড় হয়।
জেলা বাজার কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলেন, যশোরে বছরে গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার টন গুড়-পাটালি উৎপাদন হয়। মৌসুমে রস, গুড় ও পাটালির ব্যবসা হয় ৬৩ কোটি টাকারও বেশি। তার পরও যশোরে রয়েছে গুড়ের চাহিদা, সেই সুযোগটাই নেয় অসাধু গাছিরা। তবে মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ অন্যান্য এলাকার মতো এ অঞ্চলে গুড়ের কোনো কারখানা নেই। গাছিরা বাড়িতে অল্প পরিমাণে গুড় তৈরি করেন। ফলে কেউ কেউ চিনি ও ফিটকিরি ভেজাল দিলেও রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহারের তেমন অভিযোগ পাওয়া যায় না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস একই দাবি করে বলেন, এ অঞ্চলের গুড়ে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগ নেই। বরং জেলায় নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদন বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ গুড়-পাটালি উৎপাদনে আমরা গাছিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সে কারণে যশোরে খেজুরের গুড় ও পাটালির বাণিজ্য ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার বাইরে খেজুর গুড়ের অনলাইন বাণিজ্যও হচ্ছে।

বিষয় : যশোরের যশ গুড়

মন্তব্য করুন