ওদের কারও চোখেই নেই আলো। তবে নিজেদের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে শত বাধা ডিঙিয়ে ওদের মনের আলোর কাছে হার মেনেছে চোখের অন্ধকার। এই গল্প চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অনন্য সাফল্য অর্জন করা ৯ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর।
শারীরিক সীমাবদ্ধতার সঙ্গে নানা সংকট ও প্রতিকূলতা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। শ্রুতিলেখক সময়মতো না পাওয়াও তাদের ভুগিয়েছে। তবে এসব বাধা-বিপত্তি আটকাতে পারেনি তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে। সব কিছুকে পেছনে ফেলে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন তারা। স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের চারপাশ না হলেও পরীক্ষায় সফলতা পেয়ে তারা আগামীতে দেশ-বিদেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিতে চান উচ্চতর ডিগ্রি। তাদের কেউ এখন স্বপ্ন দেখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার, কেউ বা আবার স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষক কিংবা সমাজতত্ত্ববিদ হওয়ার। তবে তাদের আগামীর স্বপ্ন পূরণে বড় বাধা 'আর্থিক অসচ্ছলতা'। সরকার ও সমাজের সবাই এগিয়ে এলে তাদের 'যুদ্ধ' করা সহজ হবে।
দুই চোখে আলো না থাকার পরও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ অর্জন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মেহেরুন্নেছা পায়েল। জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় একপর্যায়ে পায়েল ও তার মাকে ছেড়ে চলে যান তার বাবা। পরে অন্য আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে হয় মায়ের। মা-বাবাহীন হয়ে পড়ায় ছোটবেলা থেকেই পায়েল বঞ্চিত হন তাদের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে। পরে নানা-নানি বড় করার দায়িত্ব নেন। তবে খরচ চালাতে না পেরে পায়েল অন্ধ হওয়ায় একপর্যায়ে তার পড়ালেখা একেবারে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তারাও। তাদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নানা-নানির ঘরও ছাড়তে হয় পায়েলকে। শুধু লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পরিবার ছাড়েন পায়েল। এমন বিপদে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সামাদ। পায়েলকে ভর্তি করে দেন স্কুলে। পায়েলকে বাবার স্নেহে গড়ে তোলেন তিনি। এসএসসিতে জিপিএ ৪ দশমিক ৬ পাওয়া পায়েল শত বাধা ভেঙে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম নগরের হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে অর্জন করেছেন জিপিএ ৫।
পায়েলের মতো অন্য আট দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে ফাতেমা বেগম পেয়েছেন জিপিএ ৪ দশমিক ৭৫, মো. হাসানুজ্জামান ৪ দশমিক ৭৫, মোহাম্মদ রাহী জী চৌধুরী ৪ দশমিক ৭৫, রিপা আক্তার ৪ দশমিক ৫৮, আবিদুর রহমান ৪ দশমিক ৫৮, শিল্পী আক্তার ৪ দশমিক ৩৩, আনিকা তাহসিন ৪ দশমিক ৩৩ এবং আসমা সুলতানা ৪ দশমিক ১৭। তারা সবাই চট্টগ্রাম নগরের হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এবারের পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে ৯ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সবাই চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী। এখান থেকে পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় তাদের।
কৃষক বাবার ছেলে মো. হাসানুজ্জামান। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনিই জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন। কৃষক বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ভালো ফলাফল উপহার দিতে পেরে আনন্দিত তিনি। মো. হাসানুজ্জামান সমকালকে বলেন, 'কৃষি কাজ করে বাবার দিনের আয় দিয়েই চলত আমাদের পুরো সংসার ও আমার লেখাপড়ার খরচ। আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেও মা-বাবার আমাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক। তাদের স্বপ্ন পূরণের ব্রত নিয়ে শত বাধা অতিক্রম করে এবারের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়ে এখন অনেক ভালো লাগছে। আগামীতে দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চাই।' চট্টগ্রাম নগরের ১০ নম্বর রুটে চলাচলরত সিটি বাসের সহকারী হিসেবে প্রতিদিন উপার্জিত টাকা দিয়েই দৃষ্টিহীন ছেলের পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন আবিদুর রহমানের বাবা মফিজুর রহমান। আবিদুর রহমান সমকালকে বলেন, 'সামান্য টাকা দিয়ে সংসার চালাতে বাবাকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। তার মধ্যে আমার পড়ালেখার ব্যয় বহন করা তার পক্ষে ছিল কষ্টসাধ্য। আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেও আমি ভেঙে পড়িনি।' বড় বোনের বেতনের টাকায় এবার ফলাফল করা রাহী জী চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'সংসারের আর্থিক অনটনের সঙ্গে আমার পড়ালেখার নানা সংকট-সমস্যা ছিল নিত্যসঙ্গী। তার পরও পড়ালেখা এক দিনের জন্যও বন্ধ করিনি। ভবিষ্যতে দেশের স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স সম্পন্ন করে এমফিলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন আমার।'
অদম্য পায়েল সমকালকে বলেন, 'নিজের জেদ আর ইচ্ছার কারণেই এতদূর আসতে পেরেছি। সপ্তম শ্রেণিতে এসে আমার পড়ালেখায় কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসে একটি বৃত্তি। তখন থেকেই সেই বৃত্তির টাকা দিয়েই চলতে থাকে পড়ালেখাসহ নিজের দৈনন্দিন খরচ। কলেজে ভর্তির পর কখনও কলেজের ছাত্রী নিবাসে, কখনও বান্ধবীদের বাসায় থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছে। অতীতের এতসব কষ্টের মুহূর্তগুলো মনে পড়লে এখন শিউরে উঠি। তবে এত বাধা-সীমাবদ্ধতার পরও জিপিএ ৫ অর্জন করতে পারা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তির। সত্যি, ফলাফল পাওয়ার পর মনে যে আনন্দ-প্রশান্তি পেয়েছি, তা আর কখনও হয়নি।' তাদের মতো অনেকটা অভিন্ন জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার সংগ্রামের গল্প বললেন অন্য শিক্ষার্থীরাও।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সামাদ সমকালকে বলেন, 'একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী জীবনের এতদূর পাড়ি দিতে কত যে কষ্ট সইতে হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে শত বাধা-সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিক্ষার্থীরা কখনও পড়ালেখা থেকে পিছপা হয় না। সবসময় ভালো ফলাফল করার নেশায় থাকে তারা। আর্থিক সংকটের মধ্যেও তারা হার মানতে রাজি নয়। তাদের এমন অধ্যবসায়ের কারণে এবার দৃষ্টিহীন ৯ শিক্ষার্থী অনন্য ফলাফল করেছে।' চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, 'অনেক স্বাভাবিক শিক্ষার্থী যেখানে সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও পরীক্ষায় ফেল করছে; সেখানে দৃষ্টিহীন ৯ শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফল আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।'

বিষয় : মনের আলোয় হার মেনেছে চোখের আঁধার

মন্তব্য করুন