
দুটো কিডনিই বিকল ছিল শরীয়তপুরের বাচ্চু মিয়ার (৫৮)। জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে ডায়ালাইসিসই ছিল তার সঙ্গী। বেসরকারিভাবে চড়া দামে ডায়ালাইসিসের পেছনে টাকা খরচ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। সরকারিভাবে কিছুটা কম দরে ডায়ালাইসিস সেবা পেতে গত ১৮ নভেম্বর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে (নিকডু) আবেদন করেন। তাতে সুপারিশ করেন সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক। তিনি লেখেন, 'মানবিক কারণে সুবিবেচনার জন্য সুপারিশ করছি।' তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বাচ্চু মিয়ার সরকারি ডায়ালাইসিসের সিরিয়ালের সুখবর আসেনি।
বাচ্চু মিয়াকে খুঁজতে গিয়ে মেলে দুঃসংবাদ। গত ২১ ডিসেম্বর বাচ্চু মিয়া মারা গেছেন। তার মেয়ে বিউটি আক্তার মৃত্যুর খবরটি জানান। বাচ্চু মিয়ার মতো গত ২ ফেব্রুয়ারি মারা যান চাঁদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী শেখ। তিনি গত ৯ ডিসেম্বর কিডনি ইনস্টিটিউটে ডায়ালাইসিসের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার আবেদনে সুপারিশ করেছিলেন মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপি। মোহাম্মদ আলী শেখের ছেলে শাহজালাল শেখ বলেন, 'দুই বছর ধরে আমার বাবা কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসক প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিসের পরামর্শ দিলেও অর্থাভাবে তা করানো যায়নি। ছয় মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে টাকার অভাবে ডায়ালাইসিসও করানো সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।'
ডায়ালাইসিসের সিরিয়াল যুদ্ধে নেমে বাচ্চু মিয়া ও মোহাম্মদ আলী শেখের মতো আরও কতজন কিডনি রোগী মৃত্যুপথে যাত্রা করেছেন, তার হিসাব নেই। কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি বিকল হয়ে মারা যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই ৫ শতাংশ মানুষেরও।
৭৫ শতাংশ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও বিষয়টি বুঝতে পারে না।
এ রকম প্রেক্ষাপটে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'সুস্থ কিডনি সবার জন্য, জ্ঞানের সেতুবন্ধনে সাফল্য।' দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিডনি চিকিৎসার একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে ডায়ালাইসিসের জন্য আবেদনের স্তূপ জমেছে। হাসপাতালটিতে গতকাল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ চেয়ে ৩ হাজার ৫৮০ জন আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ১৭৬ সিরিয়াল পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যরা এখনও অপেক্ষায়। সিরিয়াল দেওয়া রোগীর মধ্যে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব নেই কারও কাছে। কিডনি ইনস্টিটিউটে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ৬০টি মেশিনে ডায়ালাইসিস করে। সেগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১২০ জন রোগী পাওয়া যায়। মাত্র ৫১০ টাকায় ডায়ালাইসিস সুবিধার কারণে রোগীর ভিড় থাকে উপচে পড়া। আক্রান্তরা মন্ত্রী-এমপিসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে ডায়ালাইসিসের সিরিয়াল পেতে আবেদন করছেন। প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত রোগী ডায়ালাইসিস করার সুযোগ চেয়ে ভিড় করলেও কর্তৃপক্ষ তাদের আবেদন নিতে পারছে না। দেড়শ শয্যার এ হাসপাতালে ভর্তিপ্রার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ থাকে। আউটডোরেও গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নেন। লজিস্টিক সাপোর্টের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
নিকডুর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, 'হাসপাতালের লজিস্টিক সাপোর্ট অনুযায়ী ৫০ জন রোগীর মধ্যে মাত্র একজনের ডায়ালাইসিস এবং ৬০ জনে মাত্র একজন রোগী তারা ভর্তি করতে পারছেন। এতে বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শয্যাসংখ্যা না বাড়ালে রোগীর সেবা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।'
সিরিয়াল যুদ্ধ :বাচ্চু মিয়ার মেয়ে বিউটি আক্তার সমকালকে বলেন, 'এক বছর আগে আব্বার কিডনিজনিত সমস্যা ধরা পড়ে। এর পর কিডনি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য এলে চিকিৎসক সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিসের পরামর্শ দেন। বেসরকারি পর্যায়ে একবার ডায়ালাইসিসের জন্য তিন হাজার টাকা; মাসে ২৪ হাজার টাকা খরচ করতে হতো। কিডনি ইনস্টিটিউটে ৫১০ টাকায় একবার ডায়ালাইসিস নেওয়া যায়- এ খবর পাওয়ার পর সেখানে সিরিয়ালের আবেদন করি। ওই সিরিয়াল পাওয়ার আগেই বাবা চলে গেলেন!'
হালিমা বেগম আবেদন করেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সুপারিশে। হালিমা বেগমের মেয়ে মিতু আক্তার আখিলা বলেন, 'আমার মায়ের দুটি কিডনিই নষ্ট। সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। তিন বছর ধরে বেসরকারিভাবে ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে এখন অনেকটাই নিঃস্ব। গত ১৪ ডিসেম্বর কিডনি হাসপাতালে আবেদন করি। তবে এখনও সিরিয়াল পাইনি।'
ডায়ালাইসিস সেন্টার ও চিকিৎসা সংকট :জেলা পর্যায়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা নেই। দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও দেশের বড় বড় হাসপাতালে এ রোগের জন্য নেই আলাদা কোনো ইউনিট। দেশে মাত্র ৮০ থেকে ৯০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজের সবটাতে ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। নিকডু ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা. সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা আবু নাসের, সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু আছে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে কিডনি রোগীর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায়। অন্যরা অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। মাত্র ৯৬টি ডায়ালাইসিস সেন্টারে ১৮ হাজার রোগী সপ্তাহে সেবা পায়। ডায়ালাইসিস ব্যয় কমাতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তবে সেটি সরকার পারছে না। সরকার আন্তরিক হলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় মানুষের ডায়ালাইসিস নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।' তিনি আরও বলেন, 'গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে অতি দরিদ্ররা ৪০০ টাকায় এবং দরিদ্ররা ৫০০ টাকায় প্রতিবার ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাবে। আরও ১০০ টাকা দিলে তাকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে।'
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কিডনি রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পিপিপির আওতায় নিকডু এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নতুন ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ ও জেলা পর্যায়ে প্রতিটি হাসপাতালে সব মিলিয়ে আরও এক হাজার ডায়ালাইসিস শয্যা চালু হতে যাচ্ছে।
কর্মসূচি :কিডনি দিবস উপলক্ষে নিকডুতে আজ সকাল ৮টায় শোভাযাত্রা এবং পরে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ ছাড়া রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, কিডনি ফাউন্ডেশন ও ক্যাম্পস যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
মন্তব্য করুন