‘তুই কেমন করে যাবি? পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া আমাকেই তুই পাবি’- নির্মলেন্দু গুণের ‘যাত্রাভঙ্গ’ কবিতায় এভাবেই উঠে এসেছে ভালোবাসার আদ্যপান্ত। কবির লেখা পংক্তির মতো চট্টগ্রামে ঘটেছে এমন এক ঘটনা। মৃত্যুপথযাত্রী ফাহমিদা কামালের হাত ধরে ভালোবাসার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন মাহমুদুল হাসান। 

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করা ফাহমিদার স্বপ্ন ছিল ভালোবাসার মানুষ প্রেমিক মাহমুদুলের সঙ্গে ঘর বাধার। এ নিয়ে মনের মধ্যে এঁকেছিলেন নানা স্বপ্নও। বুনেছিলেন এক বুক আশা। 

তবে ফাহমিদার জীবনে অন্ধকারের বার্তা নিয়ে আসে মরণব্যাধি ক্যান্সার। কিন্তু ক্যান্সারে কি হার মানবে ফাহমিদা-মাহমুদুলের ভালোবাসা? না হার মানেনি। 

ফাহমিদা রাজি না থাকলেও গত ৯ মার্চ হাসপাতালের শয্যাতেই প্রিয়তমাকে বিয়ে করেছেন মাহমুদুল। এখনও সেই হাসপাতালেই চলছে তাদের সুখের সংসার। মাঝে একদিন তারা গিয়েছিলেন বাসায়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ফের হাসপাতালেই পেতেছেন তারা সংসার।   

হাসপাতালে এমন এক বিয়ে ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মাহমুদুল হাসানের ভালোবাসার এমন নজিরকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকে। এমন ঘটনাকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেও মন্তব্য করছেন কেউ কেউ। অনেকে বলছেন চট্টগ্রামের কোনো হাসপাতালে এটিই প্রথম বিয়ের কোনো ঘটনা।

ফাহমিদা কামাল চট্টগ্রামের দক্ষিণ বাকলিয়ার চর চাক্তাই এলাকার বাসিন্দা। গত বছরের জানুয়ারি মাসে মেধাবী এই শিক্ষার্থী আক্রান্ত হন রেকটাম ক্যান্সারে। পরে মরণব্যাধি এই রোগ থেকে বাঁচতে লড়াই শুরু করে ফাহমিদা ও তার পরিবার এবং স্বজনরা। এরইমধ্যে দেশের পাশাপাশি ভারতে গিয়েও করিয়েছেন চিকিৎসা। কিন্তু কোনো চিকিৎসায় আসছে না কাজে। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর শারীরিক অবস্থার উন্নতির বদলে আরও অবনতি হতে থাকে তার। 

দিন দিন ফাহমিদার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। শারীরিক এমন অবস্থার মধ্যেই ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন কক্সবাজারের চকরিয়ার সন্তান মাহমুদুল হাসান। তার এমন সিদ্ধান্তে অনেকটা হবাক হন সবাই। কিন্তু যেমন কথা তেমনই কাজ। বিয়েতে ফাহমিদার চাওয়া-পাওয়ার পূর্ণতা দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি মাহমুদুল। 

ফাহমিদার নাকে রয়েছে অক্সিজেনের নল, মুখ ফ্যাকাসে, কপালে ফুঁটে আছে কষ্টের বলিলেখা। তবুও ঠোটের কোণে ঝুলে আছে এক চিলতে হাসি। কারণ আজ যে ভালোবাসার মানুষটি আজীবনের জন্য ধরছে তার দুই হাত। ফাহমিদাকে লাল শাড়িতে বধুবেশে হয়েছে সাজানো, পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছেন মাহমুদুল। 

গত ৯ মার্চ উভয় পরিবারের সিদ্ধান্তে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফাহমিদাকে এভাবে বিয়ে করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। মাত্র এক টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়। ওইদিন দুজন মিলে কাটেন কেক, করেন মালা বদলও। একে অপরকে খাওয়ান খেজুর ও মিষ্টি। বিয়ের বিষয়টি অনেকটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন দুই পরিবার। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেককিছু চাইলেও যে গোপন রাখা যায় না তাই প্রমাণ হলো ফাহমিদার নানা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন সাকীর নিজের ফেসবুকে দেওয়া ফাহমিদা ও মাহমুদুলের অন্য রকম এই বিয়ের খবর ও ছবির মধ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে। 

তাদের বিয়ের ছবি সম্বলিত দেওয়া একটি স্ট্যাটাস মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় সোশাল মিডিয়ায়। যা নিয়ে পরে অনেকেই ‘ভালোবাসার অনন্য’ নজিরসহ নানা সম্বোধন লিখে নিজের ফেসবুক পেইজে ফাহমিদা ও মাহমুদুলের বিয়ের ছবিসহ দিয়েছেন স্ট্যাটাস। 

বিয়ের পর অনেকটা মনের জোরে বাড়ি ফিরেন ফাহমিদা। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যান্সার তাকে সেখানে একদিনের চেয়ে বেশি থাকার সুযোগ দেয়নি। 

একদিনের ব্যবধানে গত মঙ্গলবার ফাহমিদাকে আবারও ভর্তি হতে হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি মেডিকেল সেন্টারে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। আর তার পাশে সারাক্ষণ থাকছেন ভালোবাসার অনন্য নজির স্থাপন করা প্রেমিক মাহমুদুল। পাশে থেকে ফাহমিদার দুই হাতে হাত রেখে তিনি সারাক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন সাহস। বলছেন, ‘তুমি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে’। 

দুইজনের এমন বিয়ে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাইনি মাহমুদুল ও ফাহমিদাসহ পরিবারের সদস্যরা। 

তবে ঘটনাটি যার হাত ধরে উন্মোছিত হয়েছে সেই সাইফুদ্দিন সাকী (সম্পর্কে ফাহমিদার নানা) মুঠোফোনে সমকালকে বলেন, ‘দুজনের এমন ব্যতিক্রমী বিয়ে সত্যি আমাদের সবার জন্য অন্যরকম পাওয়া। সেইসাথে তারা দুজন এরমধ্য দিয়ে ভালোবাসার নজির স্থাপন করেছেন। সত্যিকারের ভালোবাসা কেমন তা ফুটে উঠেছে তাদের বিয়ের মধ্য দিয়ে। মানুষ চাইলে সবই সম্ভব-তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মাহমুদুল। বর্তমানে হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছেন ফাহমিদা। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।’

জানা গেছে, চট্টগ্রামের দক্ষিণ বাকলিয়ার চর চাক্তাই এলাকার বাসিন্দা এসএম কামাল উদ্দিনের তিন  ছেলে-মেয়ের মধ্যে ফাহমিদা দ্বিতীয়। ২৬ বছর বয়সী ফাহমিদা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামের বেসরকারি চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকেও এমবিএ শেষ করেন। 

৩০ বছর বয়সী মাহমুদুল হাসান কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালীর সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল হকের ছেলে। ঢাকার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করা মাহমুদুলের সঙ্গে ফাহমিদার পরিচয় হয় শিক্ষাজীবন থেকেই। দুই পরিবারই জানতেন তাদের সম্পর্কের বিষয়টি। 

আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২০ সালের শেষ দিকে তাদের বিয়েরও কথাবার্তা হয়। কিন্তু গত বছরের জানুয়ারি মাসে ফাহমিদার রেকটাম ক্যান্সার ধরা পড়লে অন্ধকার নেমে আসে দুই পরিবারে। গত ৪ মার্চ ফাহমিদাকে ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রামে এনে বেসরকারি মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ফাহমিদার শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। বর্তমানে তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। 

হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে স্বাভাবিক বিয়ের মতো করে বিয়ে করার এমন আয়োজন এটিই প্রথম। সত্যি এটি বিরল ঘটনা। ভালোবাসার অনন্য নজির এটি।