- সারাদেশ
- একের পর এক মৃত্যু সিডিএ তবু উদাসীন
একের পর এক মৃত্যু সিডিএ তবু উদাসীন

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প এলাকায় এ পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প এলাকায় লোহার পাত চাপায় পথচারী এক রিকশাচালক নিহত হন। একের পর এক মৃত্যু হলেও নগরবাসীর সুরক্ষায় সরকারি সংস্থাটির কোনো উদ্যোগ নেই। নেই জবাবদিহিও। প্রকল্প এলাকায় নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। প্রতিটি ঘটনার পর নামকাওয়াস্তে একটি ফিতা টেনে দায় সেরেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এগুলো টপকেই যাতায়াত করছেন স্থানীয়রা। এ জন্য সিডিএর উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রকল্প সংশ্নিষ্টদের দাবি, এসব স্রেফ 'দুর্ঘটনা'।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বারবার প্রকল্প এলাকায় মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড। এর দায় সিডিএকে নিতে হবে। স্বজন হারানো পরিবারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা। নয়তো এমন মৃত্যু আরও ঘটতে থাকবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিপূরণ দিয়ে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
সরেজমিন দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, নগরের হামিদিয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ডোমখালে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের শ্রমিকরা। খালের ভেতর প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের সময় পাড়ের ধস ঠেকাতে লোহার পাত পোঁতা হয়। কাজ শেষ হওয়ায় পাতগুলো তোলার কাজ করছেন তারা। গত শুক্রবার রাতে এ ধরনের একটি লোহার পাত তোলার সময় ছিটকে পড়ে রিকশাচালক মুজিবুর রহমান নিহত হন। গত রোববার দুপুরে লোহার পাত তোলার সময়ও লোকজনকে চলাচল করতে দেখা গেছে। মাঝে মধ্যে প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত পাহারাদার লোকজনকে নিবৃত করার চেষ্টা করছেন। কেউ শুনছেন। কেউ আবার শুনছেন না। দু'পাশে দুটি সাইনবোর্ড থাকলেও সতর্কীকরণ লেখাগুলো মুছে গেছে। সাইনবোর্ডের সঙ্গে লাল ফিতা টাঙানো হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে পাহারাদার মো. ঝুনু বলেন, এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো লোক চলাচল করে। কাজ চলাকালে লোকজনকে চলাচলে বাধা দিলেও তারা শোনেন না। অনেকে মোটরসাইকেল নিয়ে যান। এ কারণে ফিতা দিয়েও রাখা যায় না। স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বছরখানেক ধরে কাজ চলছে। চলাচলের বিকল্প কোনো সড়ক নেই। এ কারণে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে জলাবদ্ধতায় সড়ক-খাল একাকার হয়ে গেলে তাতে পড়ে নিখোঁজ হন সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। এ ঘটনার জন্য সিডিএকে দায়ী করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটি। নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় চসিককেও দায়ী করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে লাল পতাকা ও ব্যানার টাঙানো এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরিসহ দুর্ঘটনা রোধে ৯টি সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস। কোনো সুপারিশই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি সিডিএ। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি সরকার।
গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদে খোলা নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। ৬ ডিসেম্বর নগরের ষোলশহর এলাকায় খালে পড়ে নিখোঁজ হয় ১২ বছর বয়সী শিশু কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর তার লাশ উদ্ধার হয়। গত বছরের ৩০ জুন এই নগরের নাসিরাবাদ এলাকায় চশমা খালে পড়ে যায় একটি সিএনজি অটোরিকশা। প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম। পরে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ১৭ মার্চ লোহার পাত পড়ে নিহত মুজিবুরের পরিবারের সঙ্গে দুই লাখ ৭০ হাজার ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমঝোতা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের বহদ্দারহাটে সিডিএ নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। তখনও প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া নির্মাণ কাজ করায় মর্মান্তিক এ মৃত্যু ঘটে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও দুর্ঘটনার জন্য সিডিএর উদাসীনতাকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্তৃপক্ষ সিডিএ। বাস্তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের সব কাজই করছে সেনাবাহিনী। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন ধাপে মনিটর করা হয়। যেখানে সিডিএর কার্যকরী অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে সংস্থাটির জোরালো মনিটরিং থাকা সমীচীন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, জবাবদিহি না থাকার কারণে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। কোনো প্রকল্প শুরুর আগে প্রধান কাজ হচ্ছে নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এখানে কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তা স্পষ্ট। প্রয়োজনে পুরো প্রকল্প এলাকা সিলগালা করে দেওয়া প্রয়োজন। যাতে মানুষ প্রবেশ করতে না পারে। যেখানে কোনো কিছু ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে নেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
যা বলছে কর্তৃপক্ষ :চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমন্বয় সভা করে সিডিএকে বলেছি। কয়েক দিন আগে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলেছি।
সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, প্রকল্পটি সিডিএর হলেও বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। তাদের কয়েক দফা চিঠি দিয়ে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। এর পরও দুর্ঘটনা ঘটছে। কারণ লোকজনকে আটকানো যায় না। আবার পুরো পথ বন্ধ করে দিয়েও কাজ করা যাচ্ছে না। কারণ ওই পথ দিয়ে প্রতিদিন হাজারো লোক যাতায়াত করে। তাদের যাওয়ার বিকল্প পথ নেই। আরও সতর্কভাবে কাজ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন