প্রবাসফেরত হাতেম মিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত। গত রোববার তিনি নারায়ণগঞ্জে যান ডাক্তার দেখাতে। সেদিন দুপুরে শীতলক্ষ্যায় কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এম এল আশরাফ উদ্দিন নামের যে লঞ্চটি ডুবে যায়, সেটিতে করেই মুন্সীগঞ্জের বাড়িতে ফিরছিলেন হাতেম। গতকাল সোমবার সকালে লঞ্চটি উদ্ধার করা হলেও তার সন্ধান পাননি স্বজনরা।

মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার যোগনীঘাট এলাকার বাসিন্দা হাতেম (৫৫)। তার মেয়ে কাকলী বিলাপ করে বলছিলেন, 'বাবার ফোনে আমরা ফোন (কল) দেই, ফোন আর বাজে না। ডুইব্যা যাওয়া লঞ্চ উপরে উঠাইছে; কিন্তু ভেতরে বাবারে পাইলাম না। বাবার লাশটা খুঁইজা দেন আপনারা।'

হাতেমের স্ত্রী মোমেলা বেগম বলেন, 'আমার স্বামী হার্টের রোগী। নারায়ণগঞ্জে ডাক্তার দেখাতে তার সঙ্গে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। ডাক্তার দেখিয়ে লঞ্চে উঠার পর আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর থেকে ফোন বন্ধ পাই।

লঞ্চ পাওয়া গেল; কিন্তু আমার স্বামীকে পাওয়া গেল না।' অন্তত লাশটি খুঁজে বের করে দেওয়ার আকুতি ছিল তার কণ্ঠে।
যোগনীঘাট এলাকার বাড়িতে মা ও মেয়ের এমন আহাজারি ছুঁয়ে যায় সান্ত্বনা দিতে আসা স্বজন-প্রতিবেশীদের। তাদের অনেকের চোখ ছিল ভেজা। গলা যেন ধরে আসছিল।

লঞ্চডুবির ঘটনায় শীতলক্ষ্যার বুকে সোমবার ট্রলারে করে প্রিয়জনের খোঁজ করছিলেন অনেকেই। এ ছাড়া নদীর কয়লাঘাট ও আল আমিন নগরের তীরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা দিনভর ছোটাছুটি করেন। উদ্ধার হওয়া লাশের পাশে বসে কেউ কাঁদছিলেন, কেউ আবার আপনমনে করছিলেন বিলাপ। নদীতে যখন উদ্ধারকাজ চলছিল, তখন দুই পাড়ে আহাজারি-কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। একই পরিবেশ ছিল নিহত ও নিখোঁজ লঞ্চযাত্রীদের মুন্সীগঞ্জের বাড়িতে।

এ দুর্ঘটনায় স্ত্রী আরিফা বেগম ও শিশুসন্তান সাফায়েতকে হারিয়েছেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার রমজানবেগ এলাকার দ্বীন ইসলাম। গতকাল বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, 'আমারে বাবা কইবো কে? এমন কেউ নাই যে, আমার ছেলেরে আদর করে নাই। আল্লাহ! আমার ছেলেরে ফিরাইয়া দাও।'
তার মেয়ে মাহি আক্তারের কণ্ঠে ছিল আর্তনাদ, 'ও ভাই রে, আমার ভাই কই, আল্লাহ গো! আমার ভাই কই? আমার মা, আমার ভাই কই?'
ভাতিজিকে সান্ত্বনা দিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ফুফু ডালিয়া বেগম। ঘটনার বর্ণনা ছিল তার মুখে, 'বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ডাক্তার দেখাতে নারায়ণগঞ্জে

যান ভাবি আরিফা ও ভাতিজা সাফায়েত। ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে যায়। বাবা আব্দুর রব কোনোমতে তীরে উঠতে পারলেও ভাবি ও ভাতিজা মারা গেছেন।'
মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুরের ড্রেজার ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের লাশ নিয়ে কাঁদছিলেন তার মামাশ্বশুর জহিরুল ইসলাম মুন্সী। তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ছিল ভাগনির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

ছোট বোন আরোহী রানী রাজবংশীকে (৩) নিয়ে নারায়ণগঞ্জের নানাবাড়িতে যায় স্মৃতি রানী রাজবংশী (১৮)। রোববার দুপুরে ওই লঞ্চটিতে করে জেলার গজারিয়ার ইসমানিরচর গ্রামের বাড়িতে ফিরছিল তারা। রোববার রাত ১০টার দিকে ডুবুরিরা স্মৃতির মরদেহ উদ্ধার করে। তবে এখনও মেলেনি আরোহীর লাশ। সোমবার বিকেল পর্যন্ত তার মরদেহ পেতে শীতলক্ষ্যার তীর চষে বেড়ান বাবা জয়রাম রাজবংশী। বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। স্বজনরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তারা জানান, মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল স্মৃতির। এক দিনের মধ্যেই যে এই তরুণী স্বজনদের স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাঁই নেবে, কে তা জানত?

দুই বোনের মৃত্যুর ছায়া পড়ে গোটা গ্রামে। সমবেদনা জানাতে সোমবার স্মৃতি-আরোহীর বাড়িতে যান হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আক্তার হোসেনসহ বিশিষ্টজনেরা। স্বজনদের কান্নার ছুঁয়ে যায় তাদেরও।