
'রাজশাহী বিএনপি মানেই মিজানুর রহমান মিনু, মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও শফিকুল হক মিলন। বিএনপি নামের সঙ্গে এই তিন নেতার চেহারা বা মুখাবয়ব ভেসে ওঠে মানুষের সামনে। কিন্তু রাজশাহী বিএনপির কোনো সভা-সমাবেশেই দেখা যাচ্ছে না তাদের। এর মধ্য দিয়ে দলের বিভেদই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।' বলছিলেন বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী। তাদের মতে, অপরিচিতদের নেতৃত্বে এনে এই শীর্ষ তিন নেতাকে নিষ্ফ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে।
বিএনপির এই তিন শীর্ষ নেতা বলছেন, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর বিএনপির নেতারা সভা-সমাবেশে ডাকছেন না তাদের। আর নতুন নেতারা বলছেন, ডেকেও তাদের আনা যাচ্ছে না। তারা এও বলছেন, 'পুরোনো নেতারা নতুন নেতৃত্বকে অস্বীকার করে প্রকারান্তরে তারেক জিয়াকেই অস্বীকার করছেন।'
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি ছাড়াও ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, দুইবার দলীয় মেয়র ও এমপি। প্রায় দুই দশক একক আধিপত্য ধরে রাজশাহী অঞ্চলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ছিলেন নগর বিএনপি ও যুবদলের সভাপতি। ছিলেন সিটি মেয়রও। শফিকুল হক মিলনও দীর্ঘদিন নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন যুবদলের। তাদের হঠাৎ করেই নিষ্ফ্ক্রিয় করে রাখা নেতাকর্মীরা মানতে পারছেন না। তাদের অভিযোগ, দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তেই বারবার দলীয় নেতাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিচ্ছে।
তারা জানান, ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর মিজানুর রহমান মিনুকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সভাপতি করা হয়। এ ঘটনায় দীর্ঘদিনের ছোট ভাই-বড় ভাইখ্যাত দুই নেতা মিনু-বুলবুলের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি হয়। মিনুর অনুসারীরা তখন দলীয় কার্যালয়ে প্রায় দুই মাস তালা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। এরপর তাদের মানসিক দূরত্ব দূর হওয়ার আগেই মিনু, বুলবুল ও মিলনকে এককাতারে এনে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এই তিন নেতাকে সরিয়ে কেন্দ্র থেকে একেবারেই অপরিচিত মুখ অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশাকে সভাপতি ও মামুন অর রশীদকে সদস্য সচিব করে ৯ সদস্যের কমিটি করে পাঠানো হয়। মিনু, বুলবুল ও মিলনের অনুসারীরা তখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন এবং নতুন আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশাকে 'নিষ্ফ্ক্রিয়' ও সদস্য সচিব মামুন অর রশীদকে 'চাঁদাবাজ' আখ্যা দেন। তবে শেষ পর্যন্ত নতুন কমিটিই বহাল থাকে। পরে ৬১ সদস্যের কমিটিও অনুমোদন করে কেন্দ্র। অনুপস্থিতির বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, 'অসুস্থ থাকায় জনসমক্ষে যেতে মানা আছে। বুলবুল, মিলনও অসুস্থ। তাই রাজশাহী বিএনপির কর্মসূচিতে থাকতে পারছি না। তবে সুস্থ থাকার সময় রাজশাহীর বাইরের বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নিয়েছি।'
বিএনপির সহ-ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, 'আমাদের ডাকা হয় না। কেন ডাকা হয় না, তা নতুন নেতৃত্বই বলতে পারবেন। মহানগরে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দল যেখানে দায়িত্ব দেবে, যাব।' তিনি বলেন, 'কীভাবে যাব? ব্যানারে আমাদের নামটাও রাখা হয় না। তবে আমি বসে নেই। প্রতিদিনই সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছি। বুলবুলও যাচ্ছেন। মিনু ভাই অবশ্য অসুস্থ।'
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন বিএনপির নতুন কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈশা। তিনি বলেন, 'মিনু ভাই, বুলবুল ও মিলনকে ডাকলেও আসছেন না। তারা কেন্দ্রীয় নেতা। কিন্তু কোনো সহযোগিতা করেন না; বরং বিরোধিতা করেন। কর্মীদের আসতে নিষেধ করেন। ডাকি না, এটা মিথ্যা কথা।'
এই শীর্ষ তিন নেতা ছাড়াই বিএনপি চাঙ্গা হয়েছে জানিয়ে এরশাদ আলী ঈশা বলেন, আগে তারা শুধু গলিতে সভা করতেন। আমরা দায়িত্ব নিয়েই গলির বাইরে কর্মসূচি করছি। পুলিশ গুলি করার হুমকি দিয়েও থামাতে পারেনি। আমরা মাঠে নামছি। ওয়ার্ড কমিটি করব। চেষ্টা করছি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে।'
'অপরিচিত হয়েও কীভাবে নেতৃত্ব পেলেন'- জানতে চাইলে এরশাদ আলী ঈশা বলেন, আগে আমি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। আমরা তারেক রহমানকে অনুসরণ করছি। আমাদের কমিটি তারেক রহমান করে দিয়েছেন। উনি বলেছেন, 'ঘরে বসে কমিটি করবেন না।' বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকতসহ আমরা সবাই তারেক রহমানকে অনুসরণ করছি।
তবে মহানগরের বিএনপির সদ্য সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, 'তারেক রহমানকে আমরাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছি। তার নির্দেশেই আমরা সবাই রাজনীতি করছি। আমার ধারণা, তারা তারেক জিয়াকে ব্যবহার করছে। আমরা তারেক জিয়ার বাইরে যাব কেন? আর তারেক জিয়া কি আমাদের ডাকতে তাদের নিষেধ করেছেন? তারা কেমন করে ডাকে যে যাই না?'
মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সুইট বলেন, 'বর্তমান বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা ছিলেন সংস্কারবাদী নেতা। সদস্য সচিব মামুন অর রশীদ চিহ্নিত চাঁদাবাজ। সে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিল। আমার ধারণা, তারা নেতৃত্ব পেয়েছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে।'
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মামুন অর রশীদ বলেন, '৩ মার্চ মহানগর বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে তাদের দাওয়াত করেছি। কেউই আসেননি। দেশের অন্য জেলায় তাদের কর্মসূচি আছে বলে জানিয়েছেন। ব্যানারে কারও নামই থাকছে না। আমার নামে রাজনৈতিক মামলা আছে। তবে ছিনতাই, চাঁদাবাজির মামলা নেই। তারা প্রতিপক্ষ, তাই কথায় কথায় চাঁদাবাজ বলেন। তবে একই দলের হওয়ায় আমরা তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করি।'
মন্তব্য করুন