কিশোরগঞ্জে হাওর এলাকার নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। ইটনা, মিঠামইন, নিকলী ও অষ্টগ্রাম উপজেলার ৫৩টি হাওরের ৩০টি ফসলরক্ষা বাঁধে পানি ছুঁইছুঁই করছে। প্রায় ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় শনিবার উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা সারাদিন চেষ্টা করে কোনোভাবে রক্ষা করতে পেরেছেন।

হাওরের অবস্থা ভালো নয় এমন খবরে এদিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি দল হাওরের ফসল ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো পরিদর্শন করে নানা নির্দেশনা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসক সমকালকে বলেন, 'শনিবার রাত থেকে রোববার অর্থাৎ আগামী ৩৬ ঘণ্টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ হাওর এলাকার নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার মধ্যে রয়েছে। পানি বাঁধে ছুঁইছুঁই করছে। সামান্য পানি বেড়ে গেলে হাওরের অর্ধেক ধানি জমি তলিয়ে যাবে।'

তিনি আরও জানান, গতকাল ১০টি বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। চার উপজেলায় ছোট-বড় আরও প্রায় ৪৩টি ফসলরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি বেড়ে গেলে ফসলরক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই কৃষক পরিবারগুলোকে ৮০ ভাগ পুষ্ট ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলের প্রায় ২৪ শতাংশ জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ধান কাটার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং সহযোগিতা করা হচ্ছে।

ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রদীপ কুমার দাস জানান, গতকাল দুপুর থেকে ইটনার জিওল হাওরসহ ধনপুরের হাপনিয়া, রামপুরের চর, চরপাড়ার হাওর ও কাটুইল হাওরের বাঁধগুলোতে পানি ছুঁইছুঁই করছে। যদি পানি ৬ ইঞ্চি বেড়ে যায়, তবে নদীসংলগ্ন সব ধানি জমি তলিয়ে যাবে।

মিঠামইনের রঘুনাথপুর গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন, আজহার আলীসহ ১০ জন কৃষক জানান, উপজেলার ৮টি বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ পানি গত ২৪ ঘণ্টায় অনেকটাই বেড়ে গেছে।

ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা বলেন, এ পর্যন্ত তাদের হাতে আসা তথ্যমতে, উপজেলার ধনপুর হাওর, বাদলা হাওর, সদর ইউনিয়নের এরশাদনগর, আলালের বন, বেতেগাসহ এলংজুরী ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকেছে।

কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছাইফুল আলম জেলা প্রশাসকের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়, আসামের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া নদীতে পানি বাড়ছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টা হাওরের জন্য ক্রান্তিকাল। এদিকে, কৃষকদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতি। গত শুক্রবার ও শনিবার তারা এ কর্মসূচি পালন করে।

জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি ডা. এনামুল হক ইদ্রিস ও জেলা সিপিবির সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, হাওরে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে ফসলহানি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের সারা বছরের খাবার সরবরাহ করার দাবি জানান তারা। অন্যথায় তাদের পক্ষে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

কৃষিমন্ত্রীর কাছে কৃষকের অভিযোগ: বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবে যাওয়ার পর কৃষকদের সান্ত্বনা দিতে ও বাঁধ পরিদর্শন করতে গতকাল দিরাইয়ে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় তাকে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কথা জানান ফসলহারা কৃষকরা। মন্ত্রী হাওরের বৈশাখী বাঁধে গেলে তাড়ল গ্রামের কৃষক নূরে আলম নুরু বলেন, জমি যার পিআইসিতে (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) তার থাকার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। বাঁধে মাটি শক্তভাবে স্থাপন করা হয়নি। উচ্চতাও কম হয়েছে। এ কারণে হাজার হাজার কৃষকের ফসল ডুবেছে। যারা বাঁধের কাজ করিয়েছেন, তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. জয়া সেন গুপ্তার ঘনিষ্ঠজন এ কথাও মন্ত্রীকে বলেন ওই কৃষক।

ক্ষুব্ধ কৃষকদের সান্ত্বনা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আরও অনেকেই জানিয়েছেন। কৃষকরা বলেছেন, কোনো বছরেই বাঁধের কাজ ভালো হয় না। মন্ত্রী সান্ত্বনা দেওয়ার সময় ক্ষুব্ধ কৃষকরা বলতে থাকেন, এক ব্যক্তি চার পিআইসি নামে-বেনামে নিয়েছে।

মন্ত্রী কৃষকদের বক্তব্য শোনার পর, কৃষকরা স্লুইস গেট এবং আরেকটি বাঁধ নির্মাণের দাবি জানালে তা সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

পরে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মন্ত্রী বলেন, এক ছটাক জমি নাই তাকেও পিআইসির কমিটিতে রাখা হয়েছে। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনেক অনিয়ম আছে, এসব প্রধানমন্ত্রীকে জানাব।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য শামীমা শাহরিয়ার, কৃষি সচিব সাইদুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজীর আলম, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবীর, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোশারফ হোসেন খান, জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

দুপুরে সুনামগঞ্জের জাওয়ার হাওরে ফসল কাটার উদ্বোধন শেষে বিকালে মন্ত্রী শহরতলির বাহাদরপুর মাঠে কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

জয়া সেনগুপ্তা সমকালকে জানান, মন্ত্রী তাকে ফোনে কৃষকের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। জয়া বলেন, বাঁধে দুর্নীতি হয়ে থাকলে দিরাইবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে।