ছেলে কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই তার বাবা কাজী রফিকুল ইসলামের। কারণ শ্রাবণের বাবা যশোরের কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তার অন্য ছেলেরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও ব্যতিক্রম হয়েছে ছোট ছেলে শ্রাবণ। দীর্ঘদিনের পারিবারিক রাজনৈতিক চর্চার বিপরীতে সে গিয়ে যোগ দিয়েছে বিএনপির রাজনীতিতে।

আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিএনপির রাজনীতি করার বিষয়টি শ্রাবণের বাবাও ভালোভাবে নেননি। একারণে ছেলের সঙ্গে ইতোমধ্যেই ছিন্ন করেছেন সম্পর্ক। তবে ছেলে যে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় এতদূর এসেছে সেটা অকোপটে স্বীকার করেছেন কেশবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান এই আওয়ামী লীগ নেতা।

সোমবার দুপুরে কাজী রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ছেলেকে তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ভিন্ন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ছেলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এক যুগের বেশি সময় আমাদের সাথে কথা হয়নি, বাড়িতে আসেনি। সে এত দূর এসেছে, তার নিজস্ব প্রচেষ্টায়। আমরা তাকে কোনো অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেইনি। এমনকি জেলার কোনো আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউ তাকে সাপোর্ট দেয়নি।

তিনি আরো বলেন, আমি, আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। আমরা পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত। শ্রাবণ যখন ভিন্ন দলের রাজনীতি করা শুরু করতে লাগলো, তখন তাকে অনেকবার বুঝিয়েছি। কিন্তু সে আমাদের কথা না শুনে ছাত্রদলে যোগ দিলো। এরপর তার লেখাপড়ার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেই। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি।

শ্রাবণের বাবা আরও জানান, এখন পর্যন্ত পরিবারের সাথে শ্রাবণের সম্পর্ক ছিন্ন রয়েছে। সে পরিবার থেকে অনেক দূরে রয়েছে। এমনকি ঈদ বা কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানেও বাড়িতে আসে না। এমনকি বড়বোনের বিয়েতেও অংশ নেয়নি সে।

শ্রাবণের গ্রামের বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার চিংড়া গ্রামে। উপজেলা আ.লীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম এবং সালেহা ইসলাম দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে শ্রাবণ সবার ছোট। ২০০৩ সালে কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র শ্রাবণ কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রদল কর্মী হিসেবে হল ও বিভাগের সহপাঠীদের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।

শ্রাবণের বড় ভাই মুস্তাফিজুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাগরদাঁড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় বর্তমানে দল থেকে বহিষ্কৃত তিনি। এদিকে তার আরেক ভাই মুজাহিদুল ইসলাম পান্না উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। এছাড়া ছোট ভাই আজাহারুল ইসলাম মানিক উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক।

শ্রাবণের ভাই কাজী মাজহারুল ইসলাম বলেন, শ্রাবণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর থেকে পরিবারের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এরপরও আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ বলে বেড়ায় যে, আমাদের পরিবার বিএনপির লোকজনের সাথে জড়িত। আমাদের পরিবারের বাকি সবাই আওয়ামী লীগ করলেও সে (শ্রাবণ) তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় রাজনীতি করে।

২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন শ্রাবণ। সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে ছাত্রদল সভাপতি প্রার্থী হওয়া নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। এসময় সংবাদ সম্মেলন ডেকে শ্রাবণকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু ছাত্রদলের ওই সম্মেলনে ভোটে হেরে কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

সর্বশেষ গত রোববার শ্রাবণ ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হলে যশোরসহ তার জন্মস্থান কেশবপুরের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি। এমন ঘটনাকে এক পরিবারের মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সহাবস্থান হিসেবে দেখছেন অনেকে। এমনকি কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তারা বলছেন, শ্রাবণের এই রাজনৈতিক চেতনা কেশবপুরে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখবে।

কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার রুহুল আমিন বলেন, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও শ্রাবণ ছাত্রকাল থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে দোষের কিছু নেই।

তিনি আরও বলেন, শ্রাবণ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে, এটাকে ইতিবাচক বিষয় হিসেবেই দেখছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের দলে কোন মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে বলে মনে হয় না।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, শ্রাবণ ছাত্রদলের পরিশ্রমী ও কর্মবান্ধব ত্যাগী কর্মী। পরিবার পরিজন ছেড়ে ছাত্রদলের আদর্শ মেনে রাজনীতি করায় তার পরিবার তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। একারণে দীর্ঘদিন ধরে সে পরিবার ছাড়া। বিএনপির শীর্ষ নেতারা পুরস্কারস্বরূপ শ্রাবণকে ছাত্রদলের শীর্ষ পদ দিয়েছে। আমরা কেশবপুরবাসী খুবই খুশি।