- সারাদেশ
- হাঁড়িভাঙার বাগানে হরমোনের নির্যাতন
হাঁড়িভাঙার বাগানে হরমোনের নির্যাতন

হাঁড়িভাঙা আম
রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের বাগানে হরমোন ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। অধিক ফলনের জন্য এ বছরই প্রথম হরমোন ব্যবহার শুরু করছেন বাগান ইজারা নেওয়া ব্যবসায়ীরা। এতে করে আমের গাছগুলো দু-তিন বছরের মধ্যে মারা যেতে পারে বলে শঙ্কা চাষিদের। হরমোন ব্যবহার বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। কৃষি বিভাগ বলছে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাঁড়িভাঙা আমের জন্য প্রসিদ্ধ রংপুর জেলার মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলা। জেলার সিংহভাগ আমের ফলন হয় এ দুই উপজেলায়। আমে কম শ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা পাচ্ছেন কৃষক। সেই সঙ্গে ঝুঁকিও কম বলছেন তারা। ফলে দিন দিন ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের আবাদ থেকে সরে এসে কৃষকরা হাঁড়িভাঙা আমচাষে ঝুঁকেছেন।
আঁশবিহীন, সুস্বাদু মিষ্টি এ আম এরই মধ্যে দেশনন্দিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে এ জাতের আম। চলতি বছর রংপুরের তিন হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে রয়েছে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। এবার হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের আখিরাহাট, পদাগঞ্জহাট, পাইকারহাটসহ অন্যান্য এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আমবাগানের গাছে গাছে গুটি এসেছে। কিছুদিন আগেও মুকুলে ছেয়ে ছিল পুরো বাগান। খরতাপের কারণে এ বছর কাঙ্ক্ষিত গুটি আসেনি। তবে গাছে থাকা বিদ্যমান গুটিগুলো টিকে গেলে আমের সন্তোষজনক ফলন হবে বলে আশা করছেন আমচাষিরা। তাই দিন-রাত বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। বৈশাখের বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার শঙ্কায় বাগানগুলোতে নালা বানিয়েছেন আমচাষিরা। বৃষ্টির পানি থেকে গাছ বাঁচাতে উঁচু করা হয়েছে গাছের গোড়াগুলো।
আখিরাহাটের আমচাষি ও ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, আমগাছের বৈশিষ্ট্য হলো এক বছর বেশি ফলন হলে পরের বছর তুলনামূলক কম হয়। মানে অফ ইয়ার। এতে করে গাছ তার স্বাভাবিক নিয়মে দীর্ঘ মেয়াদে ফল দেয়। আমাদের এলাকায় কোনো চাষি কিংবা ব্যবসায়ী আমে কখনও হরমোন দেননি। এ বছর রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বাগান ডাক (ইজারা) নিয়ে গোপনে হরমোনের ব্যবহার করেছেন। ফলে গাছে অধিক আম হলেও, সেই গাছ পরের বছর ফলন দেবে কিনা আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সর্বস্ব বিনিয়োগ করে আমের বাগান করি। আমবাগানের ওপর আমাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। ব্যবসায়ীরা এসে সেই গাছের ওপর হরমোন প্রয়োগ করে অত্যাচার করছে। এতে আমরা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কায় আছি।
অন্য চাষি শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীরা এক মৌসুমের জন্য বাগান কিনে নেন। এ বছর তারা বাগানগুলোতে অধিক হারে হরমোন ব্যবহার করেছেন। এতে করে আমগাছে অধিক ফলন হলেও কয়েক বছরের মধ্যে সেই গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হাঁড়িভাঙা আম চাষের সম্প্রসারক ও আমচাষি আব্দুস সালাম বলেন, এবারই প্রথম আমাদের এলাকায় হরমোনের ব্যবহার করেছেন ব্যবসায়ীরা। এটি আমবাগানের জন্য হুমকি। তারা চাষিদের কোনো কথাই মানছেন না। কারণ তাদের প্রয়োজন আমের বেশি ফলন, সেটি করতে গাছ নষ্ট হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। এর প্রয়োগ বন্ধে হরমোন আমদানি বন্ধ করাসহ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে হরমোন ব্যবহারের ফলে এরই মধ্যে অনেক আমবাগান নষ্ট হয়ে গেছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল সমকালকে বলেন, রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীরা প্রত্যেক মৌসুমে রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের বাগান চাষিদের কাছ থেকে কিনে নেন। তারা এবার 'কালটার' নামে হরমোন ব্যবহার করছেন আমের আকার বড় হওয়ার জন্য। তারা হয়তো তাৎক্ষণিক সুফল পাবেন; কিন্তু কালটার হরমোন ব্যবহারে গাছের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।
গাছ যৌবনে অথবা তার আয়ুস্কালের আগেই মারা যেতে পারে। এই হরমোন যেন ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। তবে আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কোনো ওষুধের দোকানে এ হরমোন পাননি। শুনেছি এটি ভারত থেকে চোরাই পথে আসে। অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন