অনিয়মই এখানে নিয়ম। নামমাত্র সেবা দিয়ে জনগণের পকেট থেকে প্রতিদিন লুটে নেওয়া হচ্ছে লাখ টাকার টোল। গত পাঁচ বছরে ২২ যাত্রী প্রাণ হারালেও হয়নি কোনো মামলা। শাস্তি পেতে হয়নি কাউকেই। এই নৌঘাটে নিরাপদ কোনো নৌযান নেই। উত্তাল নদী পাড়ি দেওয়ার মতো দক্ষ চালকও নেই। যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট নেই। পণ্যের ওজন মাপার জন্য ঘাটে নেই ওজন মেশিনও। অথচ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই ঘাট থেকে প্রতিদিন লাখ টাকা টোল আদায় করছে সরকারি দুই সংস্থা- জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ। সেবা বাড়াতে তাদের মনোযোগ না থাকলেও ঘাটের মালিকানা এককভাবে নিতে তারা খুব মনোযোগী! সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করা চার লাখ বাসিন্দা তাই এই ঘাটের নাম দিয়েছে 'রক্তচোষা ঘাট'। ঘাটটির আসল নাম কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌঘাট।

জনগণ থেকে আদায় করা টোল নিয়েও হচ্ছে নয়ছয়। প্রতিদিন লাখ টাকার যে টোল আদায় হচ্ছে, তার প্রায় ৬০ শতাংশ বিআইডব্লিউটিএকে বছর শেষে দেওয়ার কথা জেলা পরিষদের। কিন্তু সরকারি এই টাকা ঠিকভাবে তাদের কোষাগারে জেলা পরিষদ জমা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ বিআইডব্লিউটিএর। গত দুই বছর জেলা পরিষদ থেকে তারা কোনো টাকা পায়নি বলে জানান সংস্থাটির উপপরিচালক নয়ন শীল। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে- টোলের নামে মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নেওয়া এই টাকা কোথায় যাচ্ছে?

নয়ন শীল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নদী-তীরবর্তী ঘাটের মালিকানা থাকার কথা বিআইডব্লিউটিএর কাছে। কিন্তু আইনি মারপঁ্যাঁচে এখনও এই ঘাটের মালিকানা জেলা পরিষদ দখল করে রেখেছে। ঘাট থেকে ওঠানো টোল থেকে প্রতিবছর আমাদের ৫৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু গত দুই বছর বিআইডব্লিউটিএ জেলা পরিষদ থেকে কোনো টোল পাইনি।

জানতে চাইলে জেলা পরিষদের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান এম এ সালাম বলেন, এ বিষয়টি দেখছে মন্ত্রণালয়। সেখানে আমাদের আপত্তি দেওয়া আছে। মন্ত্রণালয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সেভাবে বাস্তবায়ন করব। তারা যদি অর্থ পেয়ে থাকে, তবে তা পরিশোধ করবে জেলা পরিষদ। ১০ বছর জেলা পরিষদের শীর্ষ পদে থাকার পরও সন্দ্বীপের প্রধান নৌঘাটে কোনো নিয়মের বালাই নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এম এ সালাম বলেন, মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সব সময় আন্তরিক ছিলাম। এ জন্য ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটা জেটি করা হয়েছে। দুই পাশে রাস্তা করে দিয়েছে জেলা পরিষদ। আরও উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য পেলে সেবার মান আরও বাড়ানো যাবে।

চারদিকে পানিবেষ্টিত জনপদ সন্দ্বীপ। সেখান থেকে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতে নৌঘাট আছে ছয়টি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় দুটি ঘাট দিয়েই আসা-যাওয়া করতে হয় সন্দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দাকে। এই দুটি ঘাটের মধ্যে আবার কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট দিয়ে আসে ৮০ শতাংশ মানুষ। এ জন্য এই ঘাটের দিকে নজর বেশি সরকারি দুই সংস্থার।

সন্ধ্যা হতেই মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সন্দ্বীপ: স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই রুটে সীমানা নির্ধারক বয়া স্থাপন করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। বছর দুয়েক আগে ঘটা করে তারা চারটি বয়া স্থাপন করলেও তা ভেসে গেছে ঢেউয়ের স্রোতে। চারটি বয়ার কোনটি এখন কোথায় আছে, তাও বলতে পারেননি এই সংস্থার শীর্ষ কর্তাব্যক্তি। বয়া না থাকায় এখন সন্ধ্যার পর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সন্দ্বীপ। দিনের বেলা যারা লাখ টাকা টোল দেয়, রাতের বেলায় তারা হয়ে যায় আরও অসহায়। জটিল রোগী কিংবা অন্তঃসত্ত্বা কোনো নারীকে জরুরি প্রয়োজনে চট্টগ্রামে আনার দরকার হলেও তা হয়ে ওঠে পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। চট্টগ্রামস্থ সন্দ্বীপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট রিদোয়ানুল বারী বলেন, সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে এসেও একটি জনপদের মানুষ সন্ধ্যার পর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়- এটা অকল্পনীয় হলেও সত্য। জনগণ থেকে টোল আদায়ে সরকারি সংস্থাগুলো যতটা মনোযোগী, ঠিক ততটা উদাসীন তারা সেবা বাড়ানোর বিষয়ে। শুধু এ কারণে অনেক প্রসূতি মা ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে সন্দ্বীপে। সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল আলম বলেন, নৌরুটকে নিরাপদ করতে দুই সংস্থাকে অনেকবার স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। মানববন্ধন, অনশন করেছি। কিন্তু তারা এসবে কর্ণপাত করেন না। এ জন্য দু'দিন আগেও চার শিশুর প্রাণ গেছে এই ঘাটে। পাঁচ বছর আগে প্রাণ গেছে ১৮ জনের।

জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতাকেও দায়ী মনে করছে আন্দোলনে থাকা তরুণ সমাজ। সমাজকর্মী শামসুল আরেফিন শাকিল বলেন, 'জনপ্রতিনিধিদেরও আন্তরিকতায় ঘাটতি আছে। তারা চাইলে ঘাটের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারেন দিনে দিনে। কিন্তু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় সেখানে গিয়ে তারাও মুখ খোলেন না। এ জন্য জনদুর্ভোগ থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। একের পর এক দুর্ঘটনায় খালি হচ্ছে মায়ের বুক।'

চার শিশুর প্রাণ যাওয়ার পর হুঁশ হলো প্রশাসনের: স্টিমার থেকে ওঠা-নামার নিরাপদ বাহন না থাকায় শুস্ক মৌসুমে কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌপথে যাত্রীদের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে স্পিডবোট। কিন্তু এই নৌপথে স্পিডবোট চলাচলের অনুমতি নেই। এসব স্পিডবোটের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য গত ৭ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চিঠি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। কিন্তু চিঠি দেওয়ার দুই মাস পার হলেও কোনো অভিযান চালাননি ইউএনও। গত সপ্তাহে বিআইডব্লিউটিএ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে। গত বুধবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় এখানে প্রাণ হারায় চার শিশু। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল একই রুটে প্রাণ গেছে ১৮ জনের।

বিআইডব্লিউটিসির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম-বাণিজ্য) গোপাল চন্দ্র মজুমদার বলেন, 'অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য আমি সরাসরি ইউএনওদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিলেও তা করেননি।' তবে বিআইডব্লিউটিসির অবৈধ নৌযান বন্ধের চিঠির জবাবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীসা জানান, পরিকল্পিত নৌ চ্যানেলের অভাব ও নাব্য সংকটের কারণে জাহাজ বিআইডব্লিউটিএ নির্মিত জেটি থেকে প্রায় ২৫০-৩০০ ফুট দূরে মধ্য সাগরে অবস্থান করে। ছোট লালবোট দিয়ে যাত্রীদের মধ্য সাগরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অনেকে জাহাজে উঠতে চান না। চিঠির জবাবে এমনটি বললেও গত বুধবার রাতে স্পিডবোট চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন সন্দ্বীপের ইউএনও। চার শিশুর প্রাণহানির পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সেবায় আগ্রহ নেই, মালিকানা নিয়ে আছে কাড়াকাড়ি: সন্দ্বীপের প্রধান নৌরুট কুমিরা-গুপ্তছড়া টার্মিনাল জেটিঘাট ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএ মো. আবুল কাশেমের অনুকূলে ইজারা দেয়। ইজারাদার কাজ শুরুর এক দিন আগে জেলা পরিষদ মো. আনোয়ার হোসেন নামের একজনকে নৌ পয়েন্টটি ইজারা দিয়ে দেয়। এর পর শুরু হয় মামলা-মোকদ্দমা। এমন আইনি জটিলতা রেখে এই ঘাট থেকে এখন ট্যাক্স-ভ্যাটসহ প্রতিদিন ৯০ হাজার টাকা টোল আদায় করছে জেলা পরিষদ। আবার এই ঘাটের মালিকানা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে মন্ত্রণালয়ে তদবিরও করছে তারা।

ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য: বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের নৌরুটগুলোতে স্পিডবোটের কিলোমিটারপ্রতি নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা। চট্টগ্রামের কুমিরা থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার। এই হিসাবে সন্দ্বীপে যাতায়াতে স্পিডবোটের ভাড়া হওয়ার কথা ১৮০ টাকা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই রুটে যাত্রীপ্রতি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২৫০ টাকা। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই রুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা। তবে ইজারাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, 'জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ঘাটে নিজস্ব অর্থায়নে কাঠের জেটিও তৈরি করেছি আমি। জেলা পরিষদ থেকে কোনো অর্থ না পেলেও নিয়মিত বাড়িয়েছি সুযোগ-সুবিধা। দৈনিক ইজারা বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঘাট পেলে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো যেত। তার পরও আগের চেয়ে ঘাটে এখন দুর্ভোগ অনেক কম।'

যা বললেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি: অনিরাপদ ও অবৈধ নৌযান দিয়ে প্রতিদিন লাখ টাকা টোল আদায়ের কথা স্বীকার করে সন্দ্বীপের সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, 'ঘাটের সেবা বাড়ানোর দিকে উদাসীন দুই সংস্থাই। তার পরও ঘাটের মালিকানা পরিবর্তন হলে সেবার মান বাড়বে বলে আমার ধারণা। ঘাটের সমস্যা সমাধানে আমি সব সময় আন্তরিক। তার পরও কিছু মানুষ আমাকে ভুল বোঝে।' ইজারাদারকে নিয়ন্ত্রণ করে সেবার মান বাড়াতে জেলা পরিষদ ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাংসদ আরও বলেন, মানুষের দুর্ভোগ কমাতে প্রধানমন্ত্রী শতকোটি টাকায় জেটি করে দিয়েছেন। কিন্তু চর পড়ে যাওয়ায় ভাটার সময় কষ্ট করতে হচ্ছে যাত্রীদের। এই রুটের জন্য নতুন জাহাজ দেওয়া হয়েছে। তবে সি-ট্রাক না থাকায় জাহাজে ওঠা-নামায় লালবোট ব্যবহার করতে হচ্ছে। আশা করছি, শিগগির এসব সমস্যাও দূর হয়ে যাবে।

বিক্ষোভ সমাবেশ: নিরাপদ নৌরুট, দোষীদের বিচারসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল শুক্রবার উত্তাল ছিল সন্দ্বীপ। শত শত তরুণ উপজেলা কমপ্লেক্স মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। এ সময় তারা চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌরুট নিরাপদ করার আলটিমেটাম দেন। এ সমাবেশ থেকে সমাজকর্মী মো. রুস্তম বলেন, এ ঘটনায় যারা দায়ী, তাদের সবার শাস্তি চাই আমরা। নিরাপদ নৌরুট চাই। চাই নিহতদের যৌক্তিক ক্ষতিপূরণও।

তাদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে আছে- অবৈধ নৌযান পরিচালনাকারী ইজারাদার ও চালককে অতি শিগগিরই গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ নৌযানে নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। ২ এপ্রিল অবৈধ লালবোট দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিআইডব্লিউটিসির পরিচালিত জাহাজ প্রতিদিন মোট চারবার পরিচালনা করতে হবে। সর্বশেষ নিরাপদে জাহাজে ওঠানামা করার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাসান আল নাহিয়ান, মারুফ চৌধুরী, মাহিন হুজাইফা, শামসুল আজম মুন্না, আবদুর রহমান ইমন, সাজিদুল, কামরুল হাসান প্রমুখ।