- সারাদেশ
- পাঙাশের পোনা নিধন
পাঙাশের পোনা নিধন

মিঠা পানির নদ-নদীর অন্যতম সুস্বাদু মাছ পাঙাশ। এক সময় এটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে ইলিশ প্রজনন নিরাপদ করার প্রচেষ্টায় সুফল মিলেছে পাঙাশে। গত কয়েক বছরে নদ-নদীতে পাঙাশের প্রজনন বেড়েছে কয়েক গুণ। এতে আশার সঞ্চার হয়েছে সংশ্নিষ্ট বিভাগে।
তবে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অসাধু মৎস্যজীবীদের থাবায় ফিকে হয়ে যাচ্ছে আশার আলো।
গত এক মাস ধরে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে পাঙাশের পোনা। নগরের সবগুলো বাজার এবং অলিগলিতে ফেরি করে তিন থেকে ছয়-সাত ইঞ্চি আকারের পোনা বিক্রি হচ্ছে। আকার ভেদে প্রতিকেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, তারা নগরের পোর্ট রোড এবং সদর উপজেলার তালতলী, চন্দ্রমোহন এবং বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ মোকাম থেকে পাঙাশের পোনা কেনেন। প্রতিদিন শত শত মণ বিক্রি করা হয় এসব মোকামে।
মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক মাঠ কর্মকর্তা বলেছেন, পাঙাশের প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-মার্চে। এ কারণে এই সময়ে নদনদী পাঙাশের পোনায় ভরপুর। প্রজনের পর এক বছরে একটি পাঙাশের ওজন হয় প্রায় তিন কেজি।
এর সত্যতা মেলে বরিশাল সদরের চন্দ্রমোহনে। কালাবদর নদীর তীরে স্থাপিত এ মোকামটি নগরে নদীর মাছ সরবরাহের বড় কেন্দ্র। সেখানে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর নদী থেকে জেলেরা অন্য মাছের সঙ্গে পাঙাশের পোনা নিয়ে আসছেন। একেকজন জেলে প্রায় ২০ কেজি আনছেন মোকামে।
প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় ৪০টি পোনা বিক্রি হয়। সে হিসেবে প্রতিটি দাম ১০ টাকা। এক বছরে প্রতিটি ওজন হয় প্রায় তিন কেজি। ৫০০ টাকা কেজি দরে দেড় হাজার টাকা। ৪০ পিস মাছের দাম হতো ৬০ হাজার টাকা।
হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন মেঘনায় চায়না থেকে আমদানি করা 'চাঁইজাল' নামক বিশেষ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে পাঙাশ নিধনে। ১০০ থেকে ২০০ হাত লম্বা এই জালের ভেতরে ঘ্রাণজাতীয় হরমোন মিশ্রিত খাবার দিয়ে পাতা হয় নদীতে। এ খাবার খেতে এসে জালে আটকা পড়ছে পাঙাশের পোনা। এসব তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, গভীর মেঘনায় বিশেষ 'চাঁই' দিয়ে পোনা নিধনের কথা শুনেছেন তিনি।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ধলা মাঝি জানান, জেলেরা বাঁশ দিয়ে সাত-আট ফুট লম্বা 'চাঁই' তৈরি করেন। তার ভেতর ঘ্রাণযুক্ত ওষুধ মেশানো খাবার দিয়ে 'চাঁই' ডুবিয়ে রাখা হয় নদীতে। খাবার খেতে এসে শত শত পোনা ধরা পড়ছে।
আগুনমুখা নদীতে একই পদ্ধতিতে পাঙাশ নিধন করা হচ্ছে বলে জানান রাঙ্গাবালীর ক্ষুদ্র জেলে সমিতির সভাপতি মোশারফ হোসেন।
বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস জানান, মৎস্য আইনে ১২ ইঞ্চির কম আকারের পাঙাশ নিধন এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীকে এক বছরের কারাদণ্ডসহ জরিমানার বিধান রয়েছে।
তিনি জানান, ইলিশের নিরাপদ প্রজনন ও বড় হওয়া নিশ্চিত করতে অভায়শ্রমগুলোতে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল এবং আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে-পরে মোট ২২ দিন জলসীমায় সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকে। আইনটি ইলিশের জন্য হলেও এ সময় অন্যান্য মাছও নিরাপদ প্রজননের সুযোগ পায়। এ কারণে নদনদীতে পাঙাশ ও পোয়া মাছের উৎপাদন বেড়েছে। গত তিন মৌসুমে পাঁচ থেকে ১০ কেজির বেশি ওজনের মাছ ধরা পড়ছে জালে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের। পাঙাশ নিধন ও ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির চন্দ্রমোহন শাখার সভাপতি আলী আকবর আকন জানান, প্রতিদিন অর্ধশতাধিক জেলে কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদী থেকে পোনা শিকার করেন। প্রতিজন গড়ে দৈনিক ২০ কেজি করে শিকার করেন। সেই হারে ৫০ জন প্রায় এক টন শিকার করছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন বলেন, 'ইলিশ রক্ষার নিষেধাজ্ঞার সুফলে পাঙাশসহ অন্যান্য মাছের প্রজননও কিছুটা বেড়েছে। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শুধু প্রজনন করালেই হবে না, প্রজনন হওয়া মাছের সুরক্ষা মৎস্য বিভাগকেই করতে হবে। তাহলেই সুফল মিলবে।'
মন্তব্য করুন