- সারাদেশ
- চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগে বরিশালবাসীর এত কষ্ট!
চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগে বরিশালবাসীর এত কষ্ট!

চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল কিংবা বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি যাতায়াতের তেমন কোনো সহজ ব্যবস্থা নেই। একসময় বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ সার্ভিসই ছিল সহজে যাতায়াতের মূল ভরসা। কিন্তু দুটি পয়েন্টে কয়েক কিলোমিটারে নাব্য সংকটের কারণে এক দশক আগে রুটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আর চালু হয়নি। সেই থেকে যাত্রীদের চাঁদপুর কিংবা লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরী ঘাট নতুবা শরীয়তপুর হয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এভাবে ঘুরপথে একাধিক পরিবহনে করে ভেঙে ভেঙে যাতায়াতের ফলে যাত্রীদের শুধু বাড়তি ভাড়াই গুনতে হচ্ছে না, সেই সঙ্গে সইতে হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক ধকলও। এ নিয়ে চরম অসন্তুষ্ট বরিশাল ও চট্টগ্রামের মানুষ।
চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে চলাচলে জনপ্রিয় সার্ভিস ছিল বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ সার্ভিস। এই সার্ভিসে ১২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল কিংবা বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করা যেত। নাব্য সংকটের কারণে ২০১২ সাল থেকে চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ চলাচল বন্ধ। রুটটিতে চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, দুটি পয়েন্টে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার ড্রেজিং করা হলেই রুটটিতে জাহাজ চালানো যাবে। কিন্তু এক দশকেও সেই পথটুকু ড্রেজিং করা যায়নি। এ নিয়ে বরিশালবাসীর ক্ষোভের শেষ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বরিশাল বিভাগীয় ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান হৃদয়ের কথাতেই সেই ক্ষোভের চিত্র ফুটে ওঠে। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ভেঙে ভেঙে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এখন তিনটি পথে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু কমবেশি ২০ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ফলে কোনো আত্মীয়স্বজন মারা গেলে আমরা শেষ দেখাটা পর্যন্ত করতে পারি না। সমিতির সভাপতি অমিত মাহমুদ রাফি জানালেন, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর গাফিলতিতে চট্টগ্রামে যাতায়াতে বরিশালের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে। কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি। বরিশালবাসীর কষ্ট কবে মিটবে, তা কেউ জানে না।
চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে নতুন জাহাজ সার্ভিস চালু করতে গত বছরের ডিসেম্বরে একটি জরিপ চালানো হয়। এমনকি এই রুটে চালানোর জন্য বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ এমভি বার আউলিয়াকেও মেরামতের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু এত সব আয়োজন কোনো কাজে আসছে না। জরিপকারী দলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল কিংবা বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াতে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়নি। যাত্রাপথের দুটি স্থানে ডুবোচর এবং নাব্য সংকটের কারণে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে যেতে ১৬ ঘণ্টা লেগে যায়।
জানা যায়, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা-বিআইডব্লিউটিসি এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএর আট কর্মকর্তা একটি জাহাজে গত ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম-বরিশাল রুট পর্যবেক্ষণ করেন। এ নিয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্টও জমা দেয় জরিপকারী দল। তাতে দেখা যায়, পথে ভোলার সেলিম বাজার টেক হুজুরের চর এলাকায় ডুবোচর ও ভাটির কারণে নাব্য সংকটে জাহাজটি প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে থাকে। পরে জোয়ার আসার পর পানি বাড়লে জাহাজ ফের চালু করা সম্ভব হয়। এর বাইরে বরিশালের কাছাকাছি চরমোনাই এলাকায়ও নদীর পানির গভীরতা কম ছিল।
বিশেষ করে ভাটির সময় নদীতে পানির পরিমাণ যখন কমে যায়, তখন জাহাজ চালানো সম্ভব হয় না। নদীতে জেগে ওঠা চরে জাহাজের তলদেশ আটকে যায়। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। অবশ্য যেসব স্থানে নাব্য সংকট রয়েছে, সেসব স্থান ড্রেজিং করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর সংশ্নিষ্ট এক প্রকৌশলী।
বিআইডব্লিউটিসি চট্টগ্রামের ডিজিএম (বাণিজ্য) গোপাল চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে নতুন করে জাহাজ সার্ভিস চালু করতে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে দুটি স্থানে ডুবোচর ও নাব্য সংকট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সেলিম বাজার টেক হুজুরের চর এলাকায় দুই কিলোমিটার ও চরমোনাই এলাকায় তিন থেকে চার কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করা হলে জাহাজ চালানো সম্ভব। বিষয়টি রিপোর্ট আকারে আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাত্রীরা এখন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টি জরুরি। কিন্তু নাব্য সংকট নিরসন এবং ডুবোচর এড়িয়ে বিকল্প পথে জাহাজ চালানোর ব্যবস্থা করা না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টায় যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু জরিপে দেখা গেছে, ১৬ ঘণ্টার কমে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। মূলত এ কারণেই চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
জরিপ টিমের দেওয়া রিপোর্টে বলা হয়, জোয়ার-ভাটায় কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল গতিতে জাহাজ চালানো না গেলে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না। জরিপকালে জাহাজের গতি তোলা গেছে গড়ে ৭ দশমিক ২ নটিক্যাল মাইল। এই গতিতে জাহাজ চালানো হলে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে কিংবা বরিশাল থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে ১৬ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে।
সূত্র জানায়, একসময় চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া হয়ে বরিশালে জাহাজ চলাচল করত। বেশ কিছুদিন ধরে অনিয়মিতভাবে জাহাজ চলাচলের পর ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রাম-বরিশাল নৌরুটটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এর পর থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে যাতায়াতে চরম বিপাকে পড়েন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এখন যে তিনটি রুটে মানুষ চট্টগ্রাম-বরিশালে যাতায়াত করেন, সেগুলোর সবই সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বরিশাল কিংবা ভোলার ইলিশা থেকে মেঘনা পাড়ি দিয়ে লক্ষ্মীপুর হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে একদিকে যেমন লাগছে অনেক সময়, তেমনি ব্যয় হচ্ছে অর্থও। বারবার লঞ্চ-বাস আর ফেরি পাল্টানোর কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। বরিশাল-ভোলার বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসূত্রে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বসবাস করেন। লেখাপড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেও অনেককে চট্টগ্রামে যাতায়াত করতে হয়। তাই অনেক আগে থেকেই দাবি ছিল, চট্টগ্রাম-বরিশাল নৌরুট পুনরায় যেন চালু করার। দুই এলাকার মানুষ বলছেন, বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ সার্ভিস চালু করা গেলে শুধু সাধারণ যাত্রীই নয়, পর্যটন খাতেরও উপকার হতো। বরিশালের মানুষ সহজেই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বেড়ানোর সুযোগ পাবেন।
চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে দুটি জাহাজ চালানোর কথা ছিল। এর একটি এমভি বার আউলিয়া এবং অন্যটি এমভি তাজউদ্দিন। বার আউলিয়ার যাত্রী ধারণক্ষমতা ৮০০ এবং তাজউদ্দিনের ধারণক্ষমতা ৭০০ জন। আর দুটি জাহাজেরই পণ্য ধারণক্ষমতা ২০০ টন করে। জাহাজ দুটির মধ্যে এমভি তাজউদ্দিন দিয়ে রুটটিতে জরিপ চালানো হয়।
মন্তব্য করুন