বিএনপির 'বর্জন'-এর ঘোষণায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে অনেকটাই 'নির্ভার' আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি থেকে পরপর দু'দফায় নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ভোটের লড়াই আবারও জমে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যচ্ছে।

এ অবস্থায় দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনের দলীয় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করতে আজ শুক্রবার দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক ডাকা হয়েছে। এদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় গণভবনে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ বৈঠকে কুসিক ছাড়াও তিনটি উপজেলা পরিষদ, ছয়টি পৌরসভা এবং অষ্টম ধাপের ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ারও কথা রয়েছে।

এর আগে কুসিকসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমা দেওয়ার কার্যক্রম গত বুধবার শেষ হয়। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে কুসিকের মেয়র পদের জন্য মোট ১৪ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমাও রয়েছেন।
অন্যদিকে কুসিক নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি কাউকে সমর্থনও দেবে না বিএনপি। দলের কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে, তাকে দল থেকে বহিস্কারের মতো কঠোর সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত রয়েছে দলীয় হাইকমান্ডে। নির্দলীয় সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশন গঠনের পর ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কুসিকের প্রথম নির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কু বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নাগরিক কমিটির ব্যানারে জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আফজল খানকে (পরে প্রয়াত) হারিয়ে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত কুসিক নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র হন।

কুসিক নির্বাচনে হারলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে সংরক্ষিত আসনের এমপি হন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও প্রয়াত অধ্যক্ষ আফজল খানের একমাত্র মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। অন্যদিকে মেয়র নির্বাচিত হলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে 'নিষ্ফ্ক্রিয়তার' অভিযোগ এনে গত বছর মনিরুল হক সাক্কুকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এখনও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক পদে রয়েছেন তিনি।

পরাজয়ের প্রতিশোধের লক্ষ্যে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ :আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া না হলেও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা শীর্ষ পর্যায়ে নানাভাবে লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে গতবারের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা আবারও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ায় এ নিয়ে নানা গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে কুমিল্লা মহানগরজুড়ে। শেষ পর্যন্ত আবারও সীমার হাতেই নৌকার ভার ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলেও দাবি করছেন সীমার সমর্থকরা। তবে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সীমা ছাড়াও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক ওমর ফারুক, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ও অধ্যক্ষ আফজল খানের ছেলে এফবিসিসিআইর পরিচালক মাসুদ পারভেজ খান ইমরান, মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক কবিরুল ইসলাম শিকদার, সদস্য জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শফিউর রহমান, ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি সফিকুল ইসলাম শিকদার, দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান বিপ্লব, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, সাবেক ছাত্রনেতা কাজী ফারুক আহমেদ এবং পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শ্যামল চন্দ্র ভট্টাচার্য্য।
আঞ্জুম সুলতানা সীমা সমকালকে জানান, গত নির্বাচনে অংশ নিয়ে কেন পরাজিত হয়েছিলেন সেটা সবাই অবগত, নেত্রীও জানেন। তাই দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের অনুরোধে শেষ সময়ে এসে এবারও নৌকার মনোনয়ন চাচ্ছেন। এমপিরা সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে আইনগত যে বিধি আছে, দলীয় মনোনয়ন পেলে বিধি অনুসারে পদক্ষেপ নেবেন তিনি। তবে নৌকার মনোনয়ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কখনোই যাবেন না তিনি।

দলের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আরফানুল হক রিফাত বলেন, এরই মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের ২৭টি ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা তার নাম একক প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। তাই তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী।
তবে প্রার্থী যেই হোন না কেন, গত দু'বারের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে কুসিকে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে দল ও সরকারের জনপ্রিয়তার প্রমাণও দিতে চায় তারা। এ জন্য প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পরপরই দলীয় ফোরামের বৈঠক ডেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি করে দেওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে দলের মধ্যে। ২০১৭ সালের কুসিক নির্বাচনের মতো এবারও দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও সম্পৃক্ত করা হবে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনমুখী দল। যে কোনো নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়েই মাঠে থাকে তারা। তবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে যেহেতু গত দু'বার দলীয় প্রার্থী হেরেছেন, সে কারণে এবার সেখানে জয়ী হতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই চালানো হবে।

বর্জন করলেও দুই 'স্বতন্ত্র প্রার্থী' বিএনপির :দলীয়ভাবে কুসিক নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও বর্তমান মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। তার এমন সিদ্ধান্তে কোন্দলে জর্জরিত জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াসিন গ্রুপ থেকেও আলাদা স্বতন্ত্র পদে প্রার্থীর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হাজি ইয়াসিনের আত্মীয় ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মনোনয়নপত্র জমা দিলে দল থেকে বহিস্কার করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, তিনি গত দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে সফলভাবে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। নেতাকর্মী-সমর্থকদের অনুরোধে এবার স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী তিনি।

আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, বিএনপি কিছু যৌক্তিক কারণে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না; কিন্তু দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনুরোধে কুসিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেবেন তিনি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, কেউ দলের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করলে এ বিষয়ে কেন্দ্র হয়তো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। এটা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এর পরিবর্তন হবে না। এই সরকার দেশের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রত্যেক স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তারা ভোট ডাকাতি করেছে।

(তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সমকালের কুমিল্লা প্রতিনিধি কামাল উদ্দিন)