চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনের পর সৃষ্ট বিপর্যয় দেখে সারাদেশের মানুষের মধ্যেই বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। আগুন লাগার কারণ উদ্ঘাটন, ডিপোতে নিয়ম মানা হয়েছিল কিনা তার অনুসন্ধান চলবে এখন। তদন্তে নামবে নানা কমিটি। কিন্তু কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা। যেমনি গত এক যুগে দেশে ঘটে যাওয়া বড় অন্তত ৯টি অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা ভুলে গেছে সবাই। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের পরিবারগুলো সেই ক্ষত বয়ে বেড়ায় বছরের পর বছর ধরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি হয়, এই কমিটি ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড রোধে নানা সুপারিশও করে থাকে। আইন অনুযায়ী মামলাও হয়। কিন্তু মামলার তদন্ত এগোয় না। কোনো কোনোটার তদন্ত শেষ হলেও বিচার পর্যন্ত যায় না সেই মামলা। এমন পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ডের অবহেলার জন্য দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় সচেতন হয় না অন্যরাও। ফলে একের পর এক ঘটতে থাকে অগ্নিকাণ্ড।
পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখে গেছে, দেশে হতাহতের দিক দিয়ে এখন পর্যন্ত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে। পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ ওই আগুনে প্রাণ হারান ১২৪ জন, দগ্ধ হন দুই শতাধিক মানুষ। রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা সেই আগুনের লেলিহান শিখা বাতাসের সঙ্গে উড়ছিল নিমতলী-নবাবকাটরা এলাকার সরু গলির বাতাসের সঙ্গে। পুরো একটি মহল্লার বাসাবাড়িতে ছড়িয়েছিল আগুন। এতবড় ট্র্যাজেডির ঘটনায় তখন মামলা পর্যন্তও হয়নি। বিভিন্ন তদন্ত কমিটি রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত বললেও সেই গুদাম মালিককে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি। সুপারিশ অনুযায়ী গত ১২ বছরেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি রাসায়নিকের গুদাম।
এর দুই বছর পর ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর মানুষ ফের দেখে আগুনের ভয়াবহতা। ওই দিন ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন নামের গার্মেন্টে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১৭ শ্রমিক। দগ্ধ ও আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ওই অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে কারখানা ভবনটির নানা অসংগতি। ওই ঘটনায় মামলা হলেও গত ১০ বছরেও বিচার শেষ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন গ্রেপ্তার হলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি এখন ঢাকায় বড় রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের বড় নেতা।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ফের ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এবারও বাসাবাড়িতে গড়ে ওঠা রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা ওই আগুনে প্রাণ হারান ৭১ ব্যক্তি। চুড়িহাট্টার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়া সেই আগুনে পথচারীরাও হতাহত হন। ওই ঘটনায় দায়ের মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দুই বছর পর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দিলেও এখনও বিচার কাজ শেষ হয়নি।
গত বছরের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ৫১ শ্রমিক। ওই আগুনে আহত ও দগ্ধ হন অর্ধশত মানুষ। ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে কারখানা ভবনের নানা অনিয়ম বেরিয়ে এলেও শাস্তি পেতে হয়নি কাউকে। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লাগে। অভিযান-১০ লঞ্চে লাগা ওই আগুনে প্রাণ হারান ৩৮ যাত্রী। দগ্ধ হন অন্তত ৭০ জন।
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ৩১ শ্রমিক। দগ্ধ হন শতাধিক শ্রমিক। ওই আগুনে দায়ীদেরও শাস্তি পেতে হয়নি। ২০১৯ সালে রাজধানীর বনানীতে বহুতল এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ২৬ জন, আহত ও দগ্ধ হন ৭০ জন। ভবনটি নির্মাণ থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণে নানা ত্রুটি বেরিয়ে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ তিন বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি, আদালতে জমা পড়েনি চার্জশিটও।
২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানার ভয়াবহ আগুনে ১৭ শ্রমিক নিহত হন। ওই ঘটনায়ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি দায়ীদের। ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ম্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে প্রাণ হারাতে হয় ১২ জনকে। ওই বিস্ম্ফোরণের পর সড়কে গাড়িতে থাকা লোকজন ও পথচারীসহ অন্তত ১০০ জন আহত হন। আশপাশের ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এমন ঘটনার দায় কার, তাও খুঁজে বের করা যায়নি।
গত ১২ বছরে ওই ৯টি ঘটনা ছাড়াও ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজধানীর পান্থপথে অভিজাত শপিং মল বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকাণ্ডে সাতজন প্রাণ হারান। এর দুই বছর আগে ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারওয়ান বাজারে বিএসইসি ভবনে আগুনে মারা যান তিনজন। এই দুটি আগুনে হতাহত কম হলেও ওই সময়ে আতঙ্ক ছড়ায় বেশি।