
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে রাসায়নিক ও বিস্ম্ফোরক দ্রব্য। ২৮ বছর আগে আমদানি হওয়া 'বিপজ্জনক পণ্য'ও পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এখানে আছে জ্বালানি তেলের তিন ডিপো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। আছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। আছে ভোজ্যতেল সংরক্ষণের ৮৮টি টার্মিনাল। ব্যবহারের প্রয়োজনে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ করতে হয়- এমন শতাধিক শিল্পকারখানাও আছে চট্টগ্রামে। দেশে রাজস্ব আদায়কারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ল্যাবরেটরিও এই বন্দরনগরে। আমদানি-রপ্তানির সুবিধার্থে চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে ১৯টি বেসরকারি ডিপো। সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব ডিপোর কোনোটিই গড়ে ওঠেনি নীতিমালা মেনে। রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণে উদাসীনতা আছে ডিপোগুলোর। স্পর্শকাতর এতগুলো স্থাপনা গড়ে উঠলেও চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসের নেই এসব স্থাপনায় রাসায়নিক আগুন নেভানোর সক্ষমতা, যে দুর্বলতা শনিবারের বিএম ডিপোর মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডে প্রকাশ হয়ে পড়ল। অনুরূপ দুর্ঘটনায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে চট্টগ্রাম।
বড় বিপদের সংকেত :বন্দরে এর আগে কয়েক দফা বিপজ্জনক পণ্যে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত মাসেও বন্দরে রাসায়নিকভর্তি কনটেইনারে আগুন লেগেছে। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই বিকেলে ৩ নম্বর শেডে আগুন লেগেছিল। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। রাতভর বন্দরের চেয়ারম্যান ও নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন। রাত ১০টায় বিকট শব্দে বিস্ম্ফোরণ হয়। দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরতে গিয়ে একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা আহত হন।
২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে কনটেইনার খুলে কাভার্ডভ্যানে মিথানলভর্তি ড্রাম তোলার সময় বিস্ম্ফোরণ ঘটে। চারজন শ্রমিক আহত ও সামান্য অগ্নিদগ্ধ হন। একই বছর নাইট্রিক অ্যাসিডভর্তি চারটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া বের হলে আতঙ্ক ছড়ায় বন্দরে।
২০২০ সালে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম। রিপোর্টে তিনি তখন উল্লেখ করেছিলেন, যে শেডটিতে আগুন লেগেছে, সেখানে ১৯৮৭ সালে আমদানি করা পণ্যও ছিল। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামে তুলে বিক্রি করতে না পারায় পণ্যগুলো শেডটিতে রাখা হয়েছিল। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে এখনও পড়ে আছে বিপজ্জনক অনেক রাসায়নিক। এর মধ্যে আছে সালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, হাইড্রোক্লোরাইড, কস্টিক সোডা, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, রং তৈরির কাঁচামাল, টেক্সটাইল কেমিক্যাল, পারফিউমারি, ফিক্সিট সিলিকন, অ্যাস্ট্রোজেন, সারফেস অ্যাকটিভ ক্লিনিং। এগুলোর বেশিরভাগই দাহ্য ও বিস্ম্ফোরকজাতীয়। কিছু বিপজ্জনক পণ্য সরানো হলেও বন্দরের পি শেডে এখনও সব ধরনের দাহ্য ও অদাহ্য পদার্থ আছে। যথাযথ নিয়ম না মেনে অনেক রাসায়নিক রাখা আছে বন্দরের বিভিন্ন শেডে।
তড়িঘড়ি নিলাম :চট্টগ্রাম কাস্টমসের ল্যাবেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। ত্বরিত পদক্ষেপে এসব ঘটনা বড় না হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা বিপদমুক্ত নয়। বিএম ডিপোর রাসায়নিক কনটেইনারে আগুন লাগার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ বিপজ্জনক পণ্য নিলামে তোলার জন্য গত রোববার কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জরুরি চিঠি দেয়। এতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা ৬০৯ ড্রাম হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। চার বছর ধরে এগুলো পড়ে ছিল বন্দর চত্বরে। জানা যায়, ল্যাবটি যে ভবনে আছে, সেই মেয়াদোত্তীর্ণ ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে রাসায়নিকসহ বিভিন্ন পণ্যের নমুনা। এই ভবনের পাশেই কাস্টমসের মূল ভবন। এখানে কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনারসহ শীর্ষ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সবাই বসে প্রতিদিন শুল্ক্কায়নের কাজ সম্পন্ন করেন।
ঝুঁকিতে অর্ধশত স্থাপনা :চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় রয়েছে জ্বালানি তেল সরবরাহের সঞ্চালন লাইন। সড়কের ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া এ লাইন ঝুঁকি নিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করছে জ্বালানি তেল। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ডিপো থেকে জ্বালানি তেল যাচ্ছে সারাদেশে। কিন্তু স্পর্শকাতর এই স্থাপনায় নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাশে থাকা ইস্টার্ন রিফাইনারি ও ভোজ্যতেলের ৮৮টি বন্ড টার্মিনালে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণের কিছু সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠানগুলো রাখলেও সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে জানা যায়। বিস্ম্ফোরণের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মোকাবিলা করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থাপনার। চট্টগ্রামের পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানার মধ্যে বড় ধরনের রয়েছে শতাধিক। উৎপাদনের প্রয়োজনে রাসায়নিক সংরক্ষণ করতে হয় এসব কারখানাকে। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন সংশ্নিষ্টরা।
১৯ কনটেইনার ডিপো :চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের শতভাগ শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বেসরকারি ১৯টি কনটেইনার ডিপো হয়ে। বছরে প্রায় ১০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডল করেন তাঁরা। ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্যেরও শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বেসরকারি ডিপোগুলো। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ডিপোগুলোর লাইসেন্স দিলেও তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ বা পরিদর্শন করে না তারা। আমদানি-রপ্তানির জন্য নানা দাহ্য পদার্থ এসব ডিপোতে মজুত করা হলেও বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া হয় না লাইসেন্সও। কোন রাসায়নিক কত দিন ডিপোতে সংরক্ষণ করা যাবে, কোন রাসায়নিক কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে- তার নিয়ম লিপিবদ্ধ থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করছে না বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো। আগুন লাগলে করণীয় কী- তা নিয়ে ডিপো শ্রমিকদের কোনো প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় না। বিএম কনটেইনার ডিপোর ২০০ গজের মধ্যেই ছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কিন্তু রাসায়নিকের বিষয়টিতে নজর ছিল না তাঁদেরও।
৩৮ বছরে ঢিলেমি :১৯৮৪ সালে সি-ফেয়ারার্স লিমিটেড নামে বেসরকারি আইসিডি চালুর মাধ্যমে দেশে বেসরকারি ডিপোর যাত্রা শুরু হয়। এরপর কোনো নীতিমালা ছাড়াই ২০২১ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে মোট ১৯টি বেসরকারি ডিপো। ৩৮ বছর পর ঠিক হলো এসব ডিপো কীভাবে চলবে, তার নীতিমালা। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই নীতিমালা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে, যা 'বেসরকারি খাতে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ও কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) নীতিমালা-২০২১' নামে অভিহিত। এর আগে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এ নীতিমালার ব্যাপারে মতামত নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
নীতিমালা মানা হয় না :নীতিমালা অনুযায়ী নতুন স্থাপিত আইসিডিগুলোকে অবশ্যই শহরের ২০ কিলোমিটার দূরে স্থাপন করতে বলা হয়েছে। নতুন আইসিডি স্থাপনের ক্ষেত্রে নিজস্ব মালিকানাধীন জায়গা, ভাড়া জায়গা বা লিজ নেওয়া জায়গায় আইসিডি স্থাপন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নূ্যনতম ১৫ একর জায়গা এবং সাড়ে চার হাজার টিইইউএস (টোয়েন্টি ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট তথা কার্গো কনটেইনারে মাপ, প্রতিটি ২০ ফুটের সমান) কনটেইনার রাখার জায়গা থাকতে হবে। সিএফএসের আয়তন হতে হবে আইসিডির মোট আয়তনের ৫ ভাগের ১ ভাগ। আইসিডি স্থাপনে বিদেশি বিনিয়োগ থাকলে অংশীদারিত্বে নূ্যনতম ৫১ শতাংশ বাংলাদেশি মালিকানাধীন হতে হবে। এ ছাড়া আইসিডির মূল গেট জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে ২০০ মিটার দূরে রাখতে হবে। কিন্তু এই নীতিমালাও মানছেন না কনটেইনার ডিপোর কোনো মালিক।
সক্ষমতা নেই :চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৫৫ বর্গকিলোমিটারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৬০ লাখ মানুষের বসতি। অথচ এখানে ফায়ার স্টেশন আছে মাত্র ৯টি। এগুলো হলো- আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশন, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশন, চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন, নন্দনকানন ফায়ার স্টেশন, সিইপিজেড ফায়ার স্টেশন, কালুরঘাট ফায়ার, কেইপিজেড ফায়ার স্টেশন, লামাবাজার ফায়ার স্টেশন ও বন্দর ফায়ার স্টেশন। আবার এই ৯টি ফায়ার স্টেশনে নেই যথেষ্ট জনবল। বিদ্যমান জনবলকেই ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। প্রধান স্টেশন ছাড়া অন্য কোনোটিতে নেই আধুনিক নির্বাপক যন্ত্র। আবার কোনো একটি স্থানে আগুন লাগলে কাজ করতে হয় একাধিক ফায়ার স্টেশনকে। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে গবেষণায়; আর তা হলো যদি একই সময়ে চট্টগ্রামে একাধিক স্থানে আগুন লাগে তাহলে একাধিক ফায়ার স্টেশন একটি স্থানে যেতে পারবে না এবং কোন স্টেশন কোথায় অগ্নিনির্বাপণে সাহায্য করতে যাবে, তাও ঠিক করা নেই।
কে কী বলেন :চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যভর্তি পুরোনো কনটেইনার নিলামে তোলার দায়িত্ব কাস্টমসের। কিছু বিপজ্জনক পণ্য আমরা সরিয়ে নিয়েছি। তবে এখনও পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত আছি, বলা যাবে না।'
চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসান বলেন, 'ফায়ার সার্ভিসের লোকবলের অভাব, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকা, নগরের সরু রাস্তা ও পানির উৎস কমে যাওয়ার কারণে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতি বাড়ছে। বড় ধরনের বিস্ম্ফোরণ বা আগুনে এ ক্ষতির মাত্রা হবে বহুগুণ। যার উদাহরণ বিএম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড। একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ অনেক জেলা থেকে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের ডেকে আনতে হয়েছে। তবুও প্রাণহানি রোধ করা যায়নি।'
তবে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, 'বড় আকারের অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় সম্প্রতি আমাদের বহরে চারটি নতুন যন্ত্র যুক্ত হয়েছে। অতিরিক্ত ধোঁয়ার মধ্যে প্রবেশ করে আগুন নেভানোর জন্য আনা হয়েছে একটি ব্রিদিং টেন্ডার। এটি দ্বারা একসঙ্গে ২৮ জন দমকলকর্মী অতিরিক্ত ধোঁয়ার মধ্যেও প্রবেশ করে আগুন নেভাতে পারবেন। এ ছাড়া কেমিক্যাল কারখানাতে আগুন নেভাতে যুক্ত হয়েছে কেমিক্যাল টেন্ডার। তবে এসব যন্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন ২০ থেকে ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা। দরকার পানির বড় উৎসও। এ জায়গায় সংকট তীব্র হচ্ছে ক্রমশ।'
মন্তব্য করুন